নাঈমা সুলতানা
প্রকাশ: ২১:৫৪, ২২ মে ২০২৫ | আপডেট: ২১:৫৫, ২২ মে ২০২৫
সম্প্রতি শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীদের একটি গ্রুপ সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছে, পুঁজিবাজার থেকে গত আট মাসে ৯০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পুঁজিবাজারে আসলেই কী এই টাকা লোপাট হয়েছে? বিনিয়োগকারীদের যে দাবি, সেটি বলা হচ্ছে আসলে বাজার মূলধন কমার উপর ভিত্তি করে।
প্রথমে জানা দরকার, বাজার মূলধন আসলে কী? বোঝার সুবিধার্থে ধরুন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির মোট ১০০টি শেয়ার রয়েছে। যার প্রত্যেকটির আজকের বাজারমূল্য ১০ টাকা করে হলে শেয়ারবাজারের বাজার মূলধন হবে এক হাজার টাকা। এখন যদি আগামীকাল বাজারে শেয়ারগুলোর দাম ২ টাকা করে কমে যায়। তাহলে বাজার মূলধন কমে হবে ৮০০ টাকা। অর্থাৎ বাজার মূলধন কমেছে ২০০ টাকা।
ডিএসইর তথ্যে দেখা গেছে, গত আট মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
এখন আসি বাজার মূলধন কমলেই কী এই টাকা লোপাট হয়েছে বলা যাবে? প্রথমত, বাজারে যে শেয়ার রয়েছে, অর্ধেকেরও বেশি শেয়ার পরিচালক ও স্পন্সরদের হাতে থাকে যেগুলো সাধারণত লেনদেনই হয় না। অবশিষ্ট শেয়ার লেনদেনযোগ্য হলেও বাজারে লেনদেন হয় তারমধ্যে খুব সামান্য। যদি সেটি ৫ শতাংশও গড়ে লেনদেন হয় বলে ধরে নেই। তাহলে ওই ৫ শতাংশ শেয়ারের লেনদেনের উপর ভিত্তি করে অবশিষ্ট ৯৫ শতাংশ শেয়ারের মূল্য ওঠানামা করে। অর্থাৎ এই ৯৫ শতাংশ শেয়ারের লেনদেন না হলেও তাদের জন্য বাজার মূলধন কমে এবং এই লেনদেনহীন শেয়ারের জন্যই বাজার মূলধন সবচেয়ে বেশি কমে।
যেহেতু এই শেয়ারগুলোর লেনদেনই হয়নি সুতরাং এই পরিমাণ টাকা লোপাট হয়েছে এ ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া পুরোপুরি ত্রুটিপূর্ণ। বরং এটি বলা যাবে যে, বাজারে শেয়ারের মূল্য কমেছে এই পরিমাণে।
সম্প্রতি শেয়ারের দাম কমায় বিনিয়োগকারীরা সত্যিই বেশ চাপের মধ্যে পড়ে গেছেন। বর্তমানে ডিএসইর মূল সূচক পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে চলে এসেছে।
এবার আসা যাক, শেয়ারের দাম পাঁচ বছরের নিম্নে পর্যায়ে কেন নেমে আসলো? ২০২০ সালে করোনা মহামারি আসার পর পরই পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস বাসানো হয়। যেটি মাঝে অল্প সময়ের জন্য তুলে নেওয়া হলেও অন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তা বলবৎ ছিল। ফ্লোর প্রাইস সেট করে দেয়া হয় যেন শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট অংকের নিচে নামতে না পারে। কৃত্রিমভাবে হলেও শেয়ারের দাম বেশি দেখাতে আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছায় সে সময় ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়নি। অথচ এই সময়ে করোনা মহামারি, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুদ্রার মান প্রায় ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমার মতো বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। যার প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়তে পারেনি। এই ফ্লোর প্রাইস পুরো বাজারকে একটি অলমোস্ট অকার্যকর বাজারে পরিণত করে ফেলেছিল এবং শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বেশি ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়।
এদিকে যখন কোন দেশের মুদ্রার মান ৪৫ শতাংশ কমে যায় তখন সে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের দাম না কমলেও তাদের বিনিয়োগের মূল্য ৪৫ শতাংশ হারায়। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার জন্য তখন মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস থাকায় সে সময় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে পারেনি। যার প্রভাব পড়েছে যখন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হয় তখন।
শুধু কী ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়াই শেয়ারবাজার মন্দার কারণ? না। বিশ্বব্যাপী এটি একটি সাধারণ ট্রেন্ড যখন ব্যাংকিং সেক্টরে সুদের হার বাড়ে তখন শেয়ারেবাজারে শেয়ারের দাম কমে। আমাদের ব্যংকিং খাতে সুদের হার এখন ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের মতো। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হারও ১২ শতাংশের মতো। যেটি একসময় ৬ শতাংশের মতো ছিল। সুতরাং রেশনাল বিনিয়োগকারীরা বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে না রেখে নিরাপদ বিনিয়োগ ও উচ্চ হারের ট্রেজারি বিল-বন্ডের দিকেই ঝুঁকবে। এটিই স্বাভাবিক, হয়েছেও তাই। ২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলেও সেই চিত্র দেখা যায়।
এখানেই শেষ নয়। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ভালো কোম্পানিগুলোর অনেকেই গত কয়েক প্রান্তিকে তাদের মুনাফা কমার সংবাদ দিয়েছে। কারও কারও বেচাবিক্রিও কমেছে। ফলে অনেকের লভ্যাংশ দেওয়াও কমেছে। সুতরাং শেয়ারের দামে এর প্রভাব পড়াই স্বাভাবিক। এদিকে ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়লেও বেশিরভাগ ব্যাংক ভালো লভ্যাংশ দিতে পারবে না তাদের বড় অংকের খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতির কারণে। এ অবস্থায় কোম্পানির শেয়ারের দাম কমাই স্বাভাবিক।
একদিকে যখন শেয়ারবাজারের আনষঙ্গিক সব সূচকগুলোই নেতিবাচক ছিল, সেসময় নতুন কমিশনও মানুষের মাঝে আস্থা ফেরাতে পারেনি। কমিশনের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমে ধীরগতি এবং বিএসইসিতে ঘটে যাওয়া আন্দোলন মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা আরও বাড়িয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে তেমন আশার আলো দেখা দেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যতদিন না ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদের হার স্তিমিত হয়, যতদিন না তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফা পুরোনো ধারায় ফিরে আসে এবং যতদিন না বাজারে ভালো ভালো কোম্পানি নতুন করে তালিকাভুক্ত হয়, ততদিন পুঁজিবাজারে স্বস্তি ফিরবে না। সাময়িকভাবে দামের ওঠানামা হতে পারে। কিন্তু তাতে বিনিয়োগকারীরা বেশি লাভবান হতে পারবেন না।
এএ
নাঈমা সুলতানা