তারেক সিদ্দিকী
প্রকাশ: ১৬:২৭, ৫ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৬:২৭, ৫ মে ২০২৫
দেশে ব্যাংকিং খাতের আওতা এবং কার্যক্রমের পরিসর ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। আধুনিকায়নের ফলে প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে। ব্যাংকিংসেবার আধুনিকায়নের ফলে গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে সেবার মান উন্নত হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকব্যবস্থাও জটিল ও প্রতিযোগীতামূলক হয়ে উঠছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং, স্বয়ংক্রিয় লেনদেন—সব মিলিয়ে খাতটি এক নবজাগরণে প্রবেশ করেছে। এ অগ্রগতি চলমান রাখতে যে বিষয়টির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি তা শুদ্ধাচার।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অনিবার্য অংশ হিসেবে ব্যাংকারদের শুধু দক্ষ নয়, হতে হবে নৈতিকতাসম্পন্ন ও সদাচারী। কারণ ব্যাংকারের প্রতিটি আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রাহকের বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
শুদ্ধাচার মানে শুধু দুর্নীতিমুক্ত থাকা নয়। বরং শুদ্ধাচারকে কেন্দ্র করে নিজের ভেতরে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, সহানুভূতি ও বিনয়বোধকে জাগ্রত রাখা। একজন ব্যাংকার যখন কাউন্টারে বসে, তখন তিনি শুধু একজন কর্মী নন—তিনি রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের মধ্যে আস্থার সেতুবন্ধন। এই ভূমিকায় সামান্য অসততা, অহংকার, অবহেলা বা অসৌজন্যমূলক আচরণ পুরো সেবাব্যবস্থাকে কলুষিত করতে পারে।
ব্যাংকে প্রতিদিন নানান শ্রেণি-পেশার মানুষ আসেন। তাদের সঙ্গে সদয়, ধৈর্যশীল ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ করা শিষ্টাচারের প্রকাশ আর সেই আচরণে আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতা থাকলেই সেটি হয় শুদ্ধাচার। প্রায়ই অভিযোগ আসে, গ্রাহক ব্যাংকে গেলে পর্যাপ্ত সহযোগীতা পান না। নানা মহলের অভিযোগ, অনেক সময় ব্যাংকাররা কিছু গ্রাহককে বাড়তি গুরুত্ব দেন। এমনটি এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। যেমন ব্যাংকে একজন কৃষক ঋণের আবেদন করতে পারেন। এক্ষেত্রে তাকে ঋণসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করতে হবে। তাকে শুধু ঋণপ্রাপ্তির শর্ত জানালেই হবে না। ঋণ প্যাকেজের ফি, ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়া, কীভাবে শোধ করতে হবে, কীভাবে তিনি ঋণ ব্যবস্থাপনা করবেন—এসব বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা দিতে হবে। কোনো গ্রাহককে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে একজন ব্যাংকার যাচাই করতে পারেন না। কারণ ব্যাংকের কার্যক্রম যদি প্রান্তিক পর্যায়েও নিতে হয়, অবশ্যই তাকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে গ্রাহক যোগাযোগে।
যখন একজন ব্যাংকার আন্তরিক হবেন, তখন গ্রাহকের আস্থা ও ব্যাংকের প্রতি বিশ্বাস তৈরি হবে। ব্যাংক থেকে গ্রাহক উন্নত সেবা পেলে তার পরিচিতরাও আগ্রহী হবে সেবা নেওয়ার জন্য। তাই ব্যাংকারকে শুধু প্রচলিত কাজ করলেই চলবে না। তাকে মনোযোগ দিতে হবে গ্রাহক যোগাযোগ ও পরিসেবার পরিসর বাড়ানোর কাজেও। ব্যস্ততা বা চাপকে অজুহাত না করে, প্রতিটি গ্রাহকের সমস্যাকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করাই ব্যাংকারের নৈতিকতা ও মানসিক পরিপক্বতার পরিচায়ক।
শুদ্ধাচার ব্যাংকারের জন্য শুধু একটি নীতি নয়, এটি হওয়া উচিত অভ্যাস। যেমন : লেনদেনের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা, সময়ানুবর্তিতা রক্ষা, তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখা, কোনো রকম অন্যায় সুবিধা না নেওয়া, কাউকে অন্যায় সুবিধা না দেওয়া এবং সর্বোপরি দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকা—এসবই একজন আদর্শ ব্যাংকারের শুদ্ধাচারী আচরণের অংশ। এছাড়া সহকর্মীদের সঙ্গে আন্তরিকতা, দপ্তর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং শাখার ভেতরে একটি ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে তোলা—সবকিছু মিলেই শুদ্ধাচারী পরিবেশের সূচনা করে। আর এই পরিবেশই গ্রাহকের আস্থা ও সন্তুষ্টিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে।
সবশেষে বলা যায়, আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি যদি আমরা আত্মশুদ্ধির চর্চা করি, ব্যক্তিজীবনে শিষ্টাচার আর পেশাজীবনে শুদ্ধাচারকে ধারণ করি—তবে ব্যাংকিং খাত শুধু উন্নয়নেই নয়, নৈতিকতা ও মানবিকতার দিক থেকেও এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠবে।
লেখক : শাখা ব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, সোনারগাঁও শাখা