ঢাকা, বুধবার, ২১ মে ২০২৫

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, বাংলাদেশের জন্য সুযোগ

অধ্যাপক আমিনুল হক

প্রকাশ: ২২:৩৯, ১ মে ২০২৫ | আপডেট: ২২:৪৩, ১ মে ২০২৫

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, বাংলাদেশের জন্য সুযোগ

একটি দেশের জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক কাঠামো অনুযায়ী কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫ বছর-৬৪ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০ বছর-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের উর্ধ্বে) ছাড়িয়ে যায় তখন সে দেশে একটি সুযোগের সৃষ্টি হয় যে সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের উন্নতি সাধন করতে পারে। জনমিতির ভাষায় এই অবস্থানকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলে আখ্যায়িত করা হয়। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা প্রতিটি দেশ তার জীবদ্দশায় কেবল একবারই পেয়ে থাকে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল- ইইউএনএফপিএ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা হলো, “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা যা জনসংখ্যাগত কাঠামোর পরিবর্তন। প্রধানতঃ কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫ বছর-৬৪ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০ বছর-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের উর্ধ্বে) ছাড়িয়ে যায়।’’

সাধারণত ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর এই ক্ষেত্রটি তৈরি হয় কোনো দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হ্রাসের ফলে। শিশু মৃত্যুহার অনেকাংশে হ্রাসের ফলে উচ্চ জন্মহার থেকে কোনো দেশ যখন নিম্ন জন্মহারে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘদিন এই অবস্থান ধরে রাখে তখন ০-১৪ বছরের নির্ভরশীল জনসংখ্যার ভিত্তিটা অনেকাংশে ছোট হয়। পাশাপাশি দুই দশক বা তার বেশি সময়ের আগেকার জনসংখ্যার অংশটি এসময় কর্মক্ষম জনসংখ্যার (১৫ বছর-৬৪ বছর) মধ্যে প্রবেশ করে। অন্যদিকে, বয়স্ক জনসংখ্যা (৬৫ বছরের উর্ধ্বে) যে পরিমাণে থাকে তা কর্মক্ষম জনসংখ্যার সাপেক্ষে অনেক কম। এভাবে কর্মক্ষম জনসংখ্যার সাপেক্ষে তখন একটি দেশে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বেশ কম হয়ে জনবৈজ্ঞানিক মুনাফার সুযোগ তৈরি করে। যে কোনো দেশে এই সুযোগটি দুই বা তিন দশকব্যাপী বহাল থাকে।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে উচ্চ জন্মহার থেকে নিম্ন জন্মহারে প্রবেশ করেছে। ১৯৭৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে জন্মহার ছিল ৬.৩ (প্রতি হাজারে একজন মহিলা তার প্রজননক্ষম বয়সে যতজন বাচ্চা নিতে পারে) যা ২০১৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২.৩ এ (সূত্র: বিডিএইচএস-২০১৪)। একইসাথে বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারও ধনাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৬২.৪% যা ১৯৯৩-৯৪ সালে ছিল ৪৪.৬% (সূত্র: বিডিএইচএস-২০১৪)।

একইসাথে, শিশু মৃত্যুহার ৮৭ থেকে কমে এসে ২০১৪ সালে ৩৮ এ দাঁড়িয়েছে। পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার ২০১৪ সালের হিসেব অনুযায়ী ৪৬ যা ১৯৯৩-৯৪ সালে ছিল ১৩৩ (সূত্র: বিডিএইচএস-২০১৪)। শিশু মৃত্যুহার গণনা করা হয় প্রতি বছরে এক বছরের নিচে এক হাজার জীবিত শিশুর বিপরীতে মৃত শিশুর সংখ্যা এবং পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুহার গণনা করা হয় ৫ বছরের নিচে প্রতি হাজার জীবিত শিশুর বিপরীতে মৃত শিশুর সংখ্যা নিয়ে।

উল্লিখিত বিষয়ে বাংলাদেশ সাফল্যজনকভাবে উন্নতি করায় জনবৈজ্ঞানিক মুনাফার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। অধিক জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষমতার সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারলে বাংলাদেশ উন্নত দেশে উত্তরণের পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ফলে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পেতে পারে তা নিচে আলোচনা করা হলো।

দেশের মানুষের প্রায় ৫৭ শতাংশ কর্মক্ষম। এ জনসংখ্যা শ্রমবাজারে অবদান রাখতে সক্ষম। এই সময়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার সিংহভাগ থাকে তরুণ যারা সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থানকে নিয়ে যেতে পারে সর্বোচ্চ শিখরে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশ ৩ কোটি ৩২ লাখ যুবক আছে। দেশের কোন কোন খাতে ওই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো হবে তা
একটি বড় প্রশ্ন, একটি বড় চালেঞ্জ।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ফলে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি হয়। সঠিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মানসম্মত মানবসম্পদ গড়ে তোলা খুবই অপরিহার্য। একটি দেশ তার প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষকে মানব সম্পদ বানাতে পারবে কি না সেটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশ/সরকার প্রাথমিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষাসহ উচ্চ শিক্ষায় কি পরিমাণ ব্যয় করবে তার ওপর নির্ভর করবে মানব সম্পদ উন্নয়ন। মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা মানবসম্পদ তৈরিতে বিশাল ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে। দেশে মানবসম্পদ বৃদ্ধি এবং তার সুষ্ঠ প্রয়োগ/ব্যবহার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখতে পারে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কোনো দেশে অনেক সুবিধা নিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসে। একটি দেশ সেই সুযোগের কতটুকু কাজে লাগাতে পারে তা নির্ভর করে সে দেশের বিরাজমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থার ওপর। করণীয় কি তা বলতে গেলে
খুবই সোজা, কিন্তু বাস্তবায়ন করা ও বাস্তবায়নের সুফল ভোগ করা খুবই সমস্যাপূর্ণ। যেমনঃ প্রতিটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠিকে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করা, যাতে দেশে কি কি ধরনের সেবা প্রয়োজন তা দক্ষতার সাথে প্রদান করতে পারে; একই সাথে বিদেশেও গিয়ে দক্ষতার সাথে সেবা প্রদান করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যেন প্রত্যেকটি কর্মক্ষম মানুষ অসুস্থ না থাকে। একই সঙ্গে মাতৃ মৃত্যু, শিশু মৃত্যুর হার কমানো ও অপুষ্টি বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বাড়তি সঞ্চয় জনকল্যাণমুলক এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং দেশে কর্মসংস্থান করতে হবে। এটি সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তি পর্যায়ে ও এনজিওর মাধ্যমে হতে পারে। একই সঙ্গে বিদেশে কি পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি করা যায়, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। দেশে সবার জন্য সুশাসন, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা নিতে ব্যক্তি, সরকার, উদ্যোক্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর কত লোক প্রবেশ করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান রাখা দরকার। শ্রমবাজারে প্রতিটি লোকের যোগ্যতা কি, দেশে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে কি না, উন্নত বিশ্বে কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে কি না-সেগুলো গভীর ভাবে পর্যালোচনা করা ও সার্বক্ষণিক মূল্যায়ন করা জরুরি।

আনুমানিক ২০ লাখ লোক প্রতিবছর শ্রম বাজারে প্রবেশ করছে। ধারণা করা হয়, বাক্তি, সরকার, উদ্যোক্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে
মিলে সর্বমোট ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করা সম্ভব। বাকি ৮-১০ লাখকে আমরা সেবা প্রদানের সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত করতে পারিনি যা বিশাল অপচয়।

দুটি পর্যায়ে এই জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থান করতে হবে। সেবা প্রদানে ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে পরিবার ও ব্যক্তি কে এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমাজে সেবা প্রদানের যোগ্যতা থাকতে হবে এবং সেবা প্রদানের মানসিকতা থাকতে হবে। বরং সমাজে ব্যক্তির সেবা প্রদানের যোগ্যতা থাকবে, প্রয়োজনে সেবা প্রদান করবে এবং উপার্জন করবে। যেমন একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান, ফোনালাপভিত্তিক সেবা প্রদান করে উপার্জন করতে পারেন। এ ধরণের সেবা প্রদান ও উপার্জনের মানসিকতা ব্যক্তি ও পরিবারে গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে দেশে আগামী ২০২৫ অথবা ২০৩০ অথাবা ২০৩৫, ২০৪০ তে সম্ভাব্য সেবা খাত কি কি তা এখনই নিরূপণ করতে হবে এবং যুবকদের সচেতন করতে হবে যে, কোন ধরণের সেবা খাতের জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করবে। সবার কি এম.এ. পাশ করতে হবে? যে ইলেক্ট্রিশিয়ান কিংবা নার্স হবে সে কেন এম.এ. পর্যন্ত পড়ে ১৮ বছরের শিক্ষা সময় নষ্ট করবে? সে তো এস.এস.সি. পড়ে ৬-১২ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে উপার্জনমুখী হতে পারে।

২০১৬ এর হিসাব মতে দেশে ৩.৩২ কোটি যুবক আছে। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ৯ লাখ যুবককে কাজে লাগাতে হবে। দেশের উন্নয়নে কর্মক্ষম যুবকদের সর্বোচ্চ সেবা গ্রহণ করতে হবে, সেবা প্রদানে তাদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের অবশ্য এ যুবকদের কিভাবে নির্বাচনী এলাকা ভিত্তিক কাজে লাগাবেন তা ভাবতে হবে। আগামী ৩৫-৪০ বছর দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত বেশি থাকবে। বাড়তি কর্মক্ষম জনসংখ্যার জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে মনোনিবেশ করাই হবে জনবৈজ্ঞানিক মুনাফা অর্জনের উত্তম মাধ্যম। বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে। এর মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারী-পুরুষ রয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড এর সর্বোচ্চ অবস্থানে এসেও যখন একটি দেশে বেকারত্বের হার এতো বেশি থাকে তা এক প্রকার আশঙ্কার নাম। এই বৃহৎ কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কাজে লাগাতে পারলেই কেবল বাংলাদেশ পারবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে। অন্যথায় অনেক ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে এই সুযোগ এক পর্যায়ে বিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে
দেশের জন্য। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী বেড়ে যাবে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে যাবে, খরচ বাড়বে, সঞ্চয় কমবে এবং বয়স্ক লোকের সংখ্যা বাড়বে। ফলে কম লোক উপার্জন করবে আর অধিক লোক তাদের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। এসডিজি লক্ষ্য অর্জন, ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবং ভিশন-২০৪১ অর্জন করতে তথা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল গ্রহণের
বিকল্প নেই।

লেখক: অধ্যাপক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক আমিনুল হক

আরও পড়ুন