সাধারণত অনেকের চোখে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী ব্যাংক ও সুদী ব্যাংকের মধ্যে কোনো পার্থক্য ধরা পড়ে না। কারণ সুদী ব্যাংকগুলোতে যেভাবে টাকা জমা নেওয়া হয় এবং তা থেকে যেভাবে টাকা উত্তোলন করা হয় ইসলামী ব্যাংকেও প্রায় সেভাবেই টাকা জমা দেওয়া হয় এবং তা থেকে সুদী ব্যাংকের মত করেই টাকা উত্তোলন করা হয়। কাজেই অনেকে ভাবতে পারেন ইসলামী ব্যাংক আর সুদী ব্যাংকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আসলে দুটোর কার্যক্রম, নীতিমালা ও বিনিয়োগ পদ্ধতির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, দুটোর মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা এখানে ইসলামী ব্যাংক আর সুদী ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্যগুলো সংক্ষেপে পাঠকদের সামনে পেশ করছি।
- সুদী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার কার্যক্রমে ইসলামী শরিয়াহর নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। আর ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার সমস্ত কার্যক্রম ইসলামী শরিয়াহর বিধান অনুযায়ী পরিচালিত।
- সুদী ব্যাংক অর্থের ব্যবসা করে, অর্থাৎ সুদের ভিত্তিতে অর্থ ঋণ দিয়ে অর্থ উপার্জন করে। আর ইসলামী ব্যাংক অর্থের ব্যবসা করে না, বরং অর্থ দিয়ে পণ্যের ব্যবসা করে। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক ইসলামী শরিয়াহসম্মত হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থ খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করে। ইসলামী ব্যাংকের সকল বিনিয়োগই পণ্য ও সেবার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
- সুদী ব্যাংকের ভিত্তিই হলো সুদের উপর। তাই তার প্রায় সমস্ত কার্যক্রম সুদের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আর ইসলামী ব্যাংকের ভিত্তি হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। তাই তার ব্যবসা-বাণিজ্য শরিয়াহসম্মত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য থাকে একটি শরিয়াহ সুপারভাইজারি বোর্ড, যাতে থাকে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাকিং লেনদেন ও ব্যাংকিং আইন বুঝার মতো ব্যক্তি ও দক্ষ আলেম সমাজ।
- সুদী ব্যাংকের লক্ষ্য থাকে কেবল সুদ ও অধিক লাভ, তাই মানবকল্যাণের দিকে তার কোনো খেয়াল থাকে না। আর ইসলামী ব্যাংকের আসল লক্ষ্য মুনাফা হলেও তার পরবর্তী লক্ষ্য হলো মানবকল্যাণ। তাই ইসলামী ব্যাংক এমন কোনো কার্যক্রমের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করতে পারে না যাতে মানবকল্যাণ ব্যাহত হয় ।
- সুদী ব্যাংক তার মূল পুঁজির উপর কিছু রোজগার করার জন্য সুদে ঋণ দেয়। কাজেই ব্যবসায় লোকসান হলেও ঋণ গ্রহীতাকে ঋণের উপর সুদ অবশ্যই দিতে হয়। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংক ঋণ দিয়ে কিছু পেতে চায় না। তাই ইসলামী ব্যাংক সুদে ঋণ না দিয়ে মুদারাবা মুশারাকা মুরাবাহা ইত্যাদির ভিত্তিতে ব্যবসা করার জন্য অর্থ যোগান দেয়, বা ব্যবসার পণ্য বিক্রয় করে। তাই মুদারাবা মুশারাকা পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক অর্থ বিনিয়োগ করলে সে ব্যবসায় ক্ষতি হলে ব্যাংকও ইসলামী শরিয়াহর বিধান মোতাবেক ক্ষতির কিছু অংশ বহন করে।
- সুদী ব্যাংক আমানতকারীদের নির্দিষ্ট হারে সুদ দেওয়ার কথা বলে টাকা সংগ্ৰহ করে, সুতরাং ব্যাংকের মুনাফা বেশি হলেও আমানতকারীদের বেশি সুদ দেয় না। আর ইসলামী ব্যাংক ব্যবসা করার কথা বলে ব্যবসায় লাভ লোকসানের ভিত্তিতে আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। কাজেই ব্যবসায় লাভ বেশি হলে আমানতকারীদেরও বেশি লাভ দেয়।
- সুদী ব্যাংক তার পাওনাদারদের কাছ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের জন্য চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করে। ইসলামী ব্যাংক (ক্রয়বিক্রয় পদ্ধতিতে বিনিয়োগকৃত লেনদেন থেকে সৃষ্ট) মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের জন্য মূল ঋণের অতিরিক্ত কিছু নিতে পারে না। কারণ ইসলামী ব্যাংক মূলত গ্রাহকের কাছে বাকিতে ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রয় করে। এ ক্রয়বিক্রয় থেকে সৃষ্ট ঋণ পরিশোধে কোনো গ্রাহক ব্যর্থ হলে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কোনো পণ্য একবার বিক্রয় হয়ে গেলে তখন তার মালিকানা গ্রাহকের দিকে অর্পিত হয়ে যায়। তার মালিকানা আর বিক্রেতার (ব্যাংকের) থাকে না। সুতরাং বিক্রেতা আইনত শুধুমাত্র মূল্য দাবি করতে পারে। যথা সময়ে মূল্য পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য অতিরিক্ত মূল্য চাইতে পারে না। তবে চুক্তি পত্রের শর্তানুযায়ী ঋণখেলাপি মনোভাব রোধ করার জন্য শরিয়াহ বোর্ডের পরামর্শক্রমে কিছু জরিমানা নিলেও তা আমানতকারীদের মধ্যে লাভ হিসেবে মুনাফার অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না। বরং তা মানব কল্যাণের স্বার্থে দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দিতে হয়।
- সুদী ব্যাংকের মূল লক্ষ্য যেকোনোভাবে অর্থ আয় করা, তাই সুদী ব্যাংককে ভাবতে হয় না গ্রাহক কোন ধরনের পণ্যের ব্যবসা করছে এবং কিভাবে করছে। অন্য দিকে ইসলামী ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো হালালভাবে ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন করা। তাই ইসলামী ব্যাংককে ভাবতে হয়, গ্রাহক ব্যাংকের টাকা নিয়ে কোন ধরনের পণ্যের ব্যবসা করছে, আর কিভাবে করছে। তার ব্যবসার পণ্য হালাল কিনা, ব্যবসার ধরন হালাল কিনা। তার ব্যবসার পণ্য হালাল হলে এবং ব্যবসার ধরন হালাল হলেই কেবল ইসলামী ব্যাংক সে ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে, অন্যথায় বিনিয়োগ করতে পারে না ।
- ইসলামী ব্যাংক হালালভাবে হালাল পণ্যের ব্যবসা করে বলে, যে ব্যবসার কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যেমন: মাদক দ্রব্যের ব্যবসা, নাইট ক্লাব ও যেনা ব্যাভিচারের ব্যবসা, চোরা কারবারির ব্যবসা ইত্যাদি, ইসলামী ব্যাংকের অর্থ দ্বারা তা কেউ করতে পারে না। অন্যদিকে সুদী ব্যাংকের জন্য এগুলি বিবেচনায় আনা জরুরি নয়, যদি না সরকারের তরফ থেকে বাধ্যবাধকতা থাকে। অতএব ইসলামী ব্যাংক সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে এবং সমাজকে সঠিক ও স্বাভাবিক রাখতে সহযোগিতা করে। যা সুদী ব্যাংকের কাছে কখনও আশা করা যায় না।
- ইসলামী ব্যাংক আর সুদী ব্যাংকের মধ্যে আর একটি পার্থক্য হলো, ইসলামী ব্যাংকের আদর্শ মুদারাবা ও মুশারাকা বিনিয়োগ ব্যবস্থা সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হতে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে তা সকল আমানতকারীদের মধ্যে বণ্টিত হয়ে যায়। অন্যদিকে সুদী ব্যাংকব্যবস্থা পুরো অর্থ সম্পদই সমাজের গুটি কতেক মানুষের হাতে পুঁঞ্জিভূত হতে তথা পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতা করে।