ঢাকা, সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫

২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১২ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সদাসচেষ্ট

ব্যাংকার প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১০:৫৬, ৯ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১০:৫৭, ৯ জুন ২০২৫

ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সদাসচেষ্ট

ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব থেকে এই খাতকে রক্ষা করতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সদাসচেষ্ট। ব্যাংকিং খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোর পর্যাপ্ত মূলধন থাকতে হবে, যাতে কোনো ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হলে আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।

ব্যাংকিং তদারকি সংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটি (BASEL Committee on Banking Supervision) বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং তদারকির মূল ইস্যুসমূহ ও এর গুণমান উন্নয়নে পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। এ কমিটি প্রাথমিকভাবে ব্যাংকসমূহের প্রুডেনশিয়াল নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত মানদণ্ড নিরূপণ করে থাকে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিকল্পে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণ, তদারকি বৃদ্ধিই এ প্ল্যাটফর্মের মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত সুরক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালের ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ব্যাংকিং কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট থেকে ইস্যুকৃত বিসিডি সার্কুলার নম্বর ১ এর মাধ্যমে ব্যাংকিং তদারকি সংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটি কর্তৃক ১৯৮৮ সালের প্রকাশিত ব্যাসেল চুক্তি (ব্যাসেল ১) বাংলাদেশে অনুসরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পূর্বে ব্যাংকের দায়ভিত্তিক মূলধন সংরক্ষণ করা হতো। ব্যাংকের দায়ের নির্ধারিত শতকরা হারে মূলধন সংরক্ষণ করা হতো।

ব্যাসেল চুক্তি অনুসারে শুধু ঋণ ঝুঁকির আলোকে ব্যাংকসমূহের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নিরূপণ করা হতো। ঋণগ্রহীতার ধরন ও ঋণের মাত্রা বিবেচনাপূর্বক ব্যাংকের সামগ্রিক সম্পদের প্রোফাইলকে চারটি ঝুঁকিভিত্তিক শ্রেণিতে বিভক্ত করা হতো। এ চারটি শ্রেণি নিম্নরূপ :
১. সরকারের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ০%
২. সরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে ঝুঁকি ২০%
৩. ব্যাংক/নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ৫০%
৪. যে কোনো ব্যক্তি/ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ১০০%

এভাবে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নিরূপণের পর ব্যাংকসমূহকে মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ৮ শতাংশ সংরক্ষিত মূলধন হিসেবে রাখতে হতো। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ২০০৪ সালে ব্যাসেল-২ চালু হলেও সে সময় বাংলাদেশে ব্যাসেল-১ কার্যকর ছিল। এরপর জুলাই ২০০৫ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে কতিপয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিইও/ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি কাজ শুরু করে।

জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটিকে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া ২০০৬ সালের অক্টোবরে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সামর্থ্য ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপারেশনাল স্বাধীনতা নিরূপণের জন্য ব্যাসেলের মূল নীতিমালার (BASEL Core Principle) আলোকে একটি স্বনিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। এরপর ব্যাংকের সচেতনতা এবং প্রস্তুতি ন্যূনতম মূলধন আবশ্যকতার হিসাবায়নের বিষয়ে ব্যাংকসমূহের মতামত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৭ সালের এপ্রিল-মে মাসে একটি Quantitative Impact Survey (QIS) পরিচালনা করে। উল্লিখিত দুটি স্টাডি থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ব্যাংকসমূহ ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ থেকে ব্যাসেল-২ অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্যাংকিং খাতের আর্থিক ঝুঁকিসহ সব ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাসেল-২ এর এক নম্বর পিলার হচ্ছে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম মূলধন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়। ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তিন ধরনের ঝুঁকি যথা ঋণঝুঁকি, বাজারঝুঁকি, অপারেশনাল ঝুঁকি বিবেচনায় নেওয়া হয়। ঋণগ্রহীতা কর্তৃক সম্মত শর্তাবলির বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাই ঋণঝুঁকি। কাজেই প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করলে ঋণঝুঁকি সৃষ্টি হয়। বাজারমূল্যের ওঠানামার কারণে স্থিতিপত্রের অন্তর্গত এবং স্থিতিপত্র বহির্ভূত উপাদানসমূহের ক্ষতির আশঙ্কাই বাজারঝুঁকি। অপারেশনাল কর্মকাণ্ড থেকে যে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাই অপারেশনাল ঝুঁকি।

ব্যাসেল-২ এর দ্বিতীয় নম্বর পিলার হচ্ছে সুপারভাইজারি রিভিউ প্রোসেস এবং সুপারভাইজারি রিভিউ ইভালুয়েশন প্রোসেস সংলাপ। ব্যাসেল-২ এর তৃতীয় নম্বর পিলার হচ্ছে মার্কেট ডিসিপ্লিন। প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তার গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি তাদের বার্ষিক বিবরণীতে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে উক্ত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্টেকহোল্ডারগণ প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে পারেন। এ তথ্যাবলি তাদের ওয়েবসাইটেও উপস্থাপন করা যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত Quantitative Impact Survey (QIS) এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রোডম্যাপ/কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। এর প্রাথমিক
পদক্ষেপসমূহ ছিল নিম্নরূপ:

ক. Standardized Approach: External Credit Assesment Institutions (ECAIs) কর্তৃক ঋণঝুঁকির বিপরীতে ব্যাংকসমূহের ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন নিরূপণ;
খ. বাজারঝুঁকির বিপরীতে Standardized Rule Based Approach;
গ. অপারেশনাল ঝুঁকি নিরূপণের উদ্দেশ্যে Basic Indicator Approach।

এছাড়া ৩০ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখের বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৪ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধি, এ সংক্রান্ত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি কর্তৃক কর্মপরিকল্পনা/রোডম্যাপ এবং সুনির্দিষ্ট অ্যাপ্রোচ অনুমোদন, কর্ম পরিকল্পনা/রোডম্যাপ সার্কুলার আকারে ইস্যুকরণ, ব্যাসেল-২ ইউনিট গঠন ও তা কার্যকরকরণ, External Credit Assesment Institutions (ECAIs) এর স্বীকৃতির লক্ষ্যে নিয়ম প্রণয়ন, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময়, ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খসড়া গাইডলাইন প্রস্তুতকরণ, দ্বিতীয় Quantitative Impact Survey (QIS) এর অগ্রগতি, ব্যাসেল-২ কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত সার্কুলার জারিকরণ, ব্যাসেল-১ ও ব্যাসেল-২ নীতিমালা অনুযায়ী ন্যূনতম মূলধন
হিসাবায়ন, Internal Rating Based Approach (IRBA) এ মাইগ্রেশন, QIS এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাসেল-২ বাস্তবায়ন সেল এবং তদারকি বিভাগ কর্তৃক প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য পৃথকভাবে কার্য সম্পাদনের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার পূর্বে ঐ প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করতে হয়। ইতিপূর্বে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী নিজেরাই ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানসমূহের রেটিং করত। কিন্তু সঠিকভাবে আন্তর্জাতিক মানের রেটিং না করার ফলে অনেক সময় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের সম্মুখীন হয়। কোনো কোনো সময় ঋণ ফেরত দিতে পারে না। এতে ব্যাংকের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। খেলাপি ঋণের হার বেড়ে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ে। ঋণঝুঁকি থেকে ব্যাংকগুলোকে মুক্ত করতে এবং ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে ব্যাসেল-২ এর আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই দিকনির্দেশনার আলোকে প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার মানদণ্ড নির্ণয় করতে বাংলাদেশ ব্যাংক রেটিং এজেন্সি মনোনয়ন করে। এদিকে অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও (নন ব্যাংক) ব্যাসেল-২ বাস্তবায়ন করা হয়। এরই অংশ হিসেবেই ২০১২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রত্যেক অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তাদের মূলধন ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮ তারিখের বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর ৯ এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে প্রতি তিনমাস অন্তর ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৯ তারিখের বিআরপিডি সার্কুলার নম্বর ২০ এর
মাধ্যমে ব্যাংকসমূহকে জানানো হয় যে, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ব্যাসেল-২ বাস্তবায়িত হবে এবং ইতিপূর্বে ইস্যুকৃত এ সংক্রান্ত সকল দিকনির্দেশনা কার্যকর থাকবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, মূলধনের পর্যাপ্ততা এবং এ সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্টদের জানানো সংক্রান্ত নির্দেশনাসমূহ পরিপালনের জন্য সকল বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়।

সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস

এএ

 

ব্যাংকার প্রতিবেদন

আরও পড়ুন