ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

ধারনির্ভর হয়ে পড়ছে দেশের ব্যাংকগুলো

ব্যাংকার প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৮:০৯, ১৫ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৮:০৯, ১৫ মে ২০২৫

ধারনির্ভর হয়ে পড়ছে দেশের ব্যাংকগুলো

দেশের ব্যাংকগুলো পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারনির্ভর হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা ধার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে গড়ে ৮৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা ধার দেয়া হয়েছে রেপোর মাধ্যমে। আর স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট বা বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় প্রতি মাসে ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে ৯৬ হাজার ১৪ কোটি টাকা। 

দেশের মুদ্রাবাজারের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা ‘মানি মার্কেট ডাইনামিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো অর্থের জোগানের জন্য প্রথমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) যায়। সেখানে পর্যাপ্ত অর্থ না মিললে রেপোর মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে ধার দেয়া ব্যাংকের কাছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ধক রাখতে হয়। কলমানি কিংবা রেপোর মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে তবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে রেপোর সুদহার ১০ শতাংশ। আর স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টের সুদহার নির্ধারিত রয়েছে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। এরপর দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো রেপোর চেয়ে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে বেশি অর্থ ধার করছে। 

দৈনন্দিন লেনদেন শেষে কোনো ব্যাংক সিআরআর (আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ) ঘাটতিতে পড়লে তবেই স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নেয়।  আর দিনের নির্দিষ্ট সময়ে আবেদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নেয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড তথা সিকিউরিটি বন্ধক রাখতে হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত তিন বছর দেশের ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে। আর কিছু ব্যাংকের সংকট গভীর হওয়ায় তারা পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারনির্ভর হয়ে পড়েছে। ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত কয়েকটি ব্যাংকও রেপো এবং স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়া অর্থে ওই ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনছে। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থে সরকারকে ঋণ দিয়ে ওই ব্যাংকগুলো বড় অংকের মুনাফা করছে।

রেপোতে ধার নিয়ে সরকারি বিল-বন্ড কেনাকে অনৈতিক চর্চা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করছেন, রেপোতে ধার নিয়ে সে অর্থে বিল-বন্ড কেনা অবৈধ না হলেও এটি অনৈতিক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস তথা গত জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নেয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। ওই মাসে একদিন মেয়াদি রেপোতে ১ হাজার ৬৫১ কোটি, সাতদিন মেয়াদি রেপোতে ২৩ হাজার ৯৭৮ কোটি, ১৪ দিন মেয়াদি রেপোতে ২৯ হাজার ১৬৫ কোটি ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপোতে ৪১ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা ধার করেছে ব্যাংকগুলো। 

এর পরের মাসগুলোতে রেপোতে ধার নেয়ার প্রবণতা কোনো মাসে কমেছে, আবার কোনো মাসে বেড়েছে। ব্যাংকগুলো আগস্টে ৮১ হাজার ৬৬৮ কোটি, সেপ্টেম্বরে ৯৫ হাজার ৪০৫ কোটি, অক্টোবরে ৯৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা রেপোতে ধার নেয়। নভেম্বরের পর থেকে এ ধারের পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। 

সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে রেপোতে ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে গড় ধারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫ হাজার ৯০ কোটি টাকায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে,  গত বছরের জুলাইয়ে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টে ব্যাংকগুলোর নেয়া ধারের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। আগস্টে গিয়ে এ ধারের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই মাসে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দিয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে বিশেষ এ ধার ১ লাখ ১০ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। এরপর অক্টোবরে কিছুটা কমে এলেও নভেম্বরে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকায়।

ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে এ ধার ৮০ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসে আবারো ১ লাখ ৭ হাজার ৭১ কোটি টাকায় উঠে যায়। আর সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে ব্যাংকগুলো ৯৪ হাজার ২১৬ কোটি টাকা ধার করেছে। 

সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে ৯৬ হাজার ১৪ কোটি টাকার বিশেষ এ ধার দিয়েছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গত দুই অর্থবছর ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য রেপো বা নীতি সুদহার পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে। রেপো রেট ৫ থেকে বাড়িয়ে উন্নীত করা হয় ১০ শতাংশে। আর সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে ১১ থেকে ১৩ শতাংশে। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে অনেক ব্যাংক ১ থেকে দেড় শতাংশ মুনাফা বের করে নিচ্ছে। 

বেসরকারি খাতে না দিয়ে ব্যাংকগুলো এখন অর্থের সংকটে থাকা সরকারকে বেশি ঋণ দিচ্ছে। এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও গত মার্চ পর্যন্ত সরকারের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। ওই মাসে ব্যাংক খাত থেকে নেয়া সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৫৪ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।

এএ

ব্যাংকার প্রতিবেদন

আরও পড়ুন