ঢাকা, শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫

২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৯ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

তারুণ্য : জীবন গড়ার শ্রেষ্ঠ সময়

তাশফিয়া ইসলাম বিভা

প্রকাশ: ১৯:৪৮, ২৯ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৯:৪৮, ২৯ মে ২০২৫

তারুণ্য : জীবন গড়ার শ্রেষ্ঠ সময়

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৮ বছর। এই প্রায় তিয়াত্তর বছরের জীবনে শৈশব, কৈশোর, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য বাদ দিলে মাঝের সময়টুকু হচ্ছে তারুণ্য। জাতিসংঘ ১৪ বছর থেকে ২৪ বছর সময়টাকে তারুণ্য বলে সংজ্ঞায়িত করেছে।

আসলে তারুণ্য এক বিশাল শক্তি। এই শক্তিকে আত্মনিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই সম্ভব নিজের ও অন্যের কল্যাণে কিছু করা। আর গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গেলেই হবে সর্বনাশ! যতটা না অন্যের, ততোধিক নিজের। 

যে বয়স বল্গাহারা হবার
আমাদের শৈশব কৈশোর কাটে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে। প্রৌঢ়ত্ব কাটে পেশাগত আর পারিবারিক জীবনের চক্রে; বার্ধক্য চলে যায় শারীরিক নানা অবস্থা আর জীবনের হিসেব মেলাতে। বাকি রইলো তারুণ্য। এই সময়ে এসে মানুষ কৈশোরের সীমা পার হয়ে যুবা বয়সের দরজায় দাঁড়ায়। এক ধরণের স্বাধীনতার স্বাদ পায় এসময়টায়। মুশকিলটা হয় তখনই। উদ্দাম বল্গাহারা হয়ে পড়ে অনেকে।

জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তারুণ্য
নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেবার, মেধাকে বিকশিত করার, ভুল থেকে শেখার শ্রেষ্ঠ সময় এটি। কথার কথা না, রীতিমত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উঠেছে এসেছে ব্যাপারটা।  

সময়ের প্রক্রিয়া বোঝা, পরিণতি ও সম্ভাব্যতা অনুমান, অমীমাংসিত বিষয়ের উত্তর খোঁজার কাজ করে থাকে আমাদের মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ বা ফ্রন্টাল লোব। এই অংশটি পরিপক্ক হয় মোটামুটি মধ্য বিশে, অর্থাৎ তারুণ্যে।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণামতে, মধ্য বিশ মানুষের ভেতরে নিয়মানুবর্তিতা এবং গুছিয়ে কাজ করার দক্ষতা বিকশিত হওয়ারও উপযুক্ত সময়। তাই এই সময়ের সিদ্ধান্ত ও কাজ জীবনের গতিপথে ফেলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব।

কাজেই আপনি যদি তরুণ হয়ে থাকেন তাহলে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে ব্যর্থ জীবনের জন্যে কপাল চাপড়াবেন, নাকি সফল-পরিতৃপ্ত-সুখীজীবনের অধিকারী হবেন তা নির্ভর করছে তারুণ্যকে আপনি কীভাবে কী কাজে ব্যয় করছেন তার ওপর।

তারুণ্যকে যেভাবে অপচয় করছে অনেক তরুণ
‘লাইফ ইজ আ পার্টি, ক্র্যাশ ইট’– পশ্চিমা সংস্কৃতির এই প্রতিপাদ্যকে আপন করে নিতে দেখা যাচ্ছে এদেশের তরুণদেরও। যা তাদের প্ররোচিত করছে উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটে চলতে। আবার এক ধরণের আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা দেখা যায় কারো কারো মধ্যে, যেখানে মেধা নষ্ট করা স্মার্টনেসের লক্ষণ এবং লতাগুল্মের মতো লক্ষ্যহীন ভেসে বেড়ানোতে দোষের কিছু নেই। ইংরেজীতে একে বলা হয় ‘থ্রো-এওয়ে মেন্টালিটি’। ভাবখানা এমন- জীবনকে অবলীলায় ছুড়ে দাও; তারপর কোনোরকমে একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারলেই হয়ে গেল!

এসবই ভোগবাদী পশ্চিমা ভাবধারা অনুকরণের প্রভাব, ‘ইনডিভিজুয়ালিজম’ এবং ‘খাও দাও ফূর্তি করো’ যার মূল প্রতিপাদ্য।  

অথচ প্রাচ্যে একসময় কৈশোর থেকেই শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, সামাজিক ফিটনেস অর্জনের শিক্ষা শুরু হয়ে যেত। ফলে তারুণ্যে তাদের খেই হারিয়ে ফেলার সুযোগ থাকত না। সেবার মানসিকতা গড়ে উঠত তরুণদের মধ্যে। অর্থপূর্ণ জীবন গঠন করাই হতো তাদের ধ্যানজ্ঞান।  

পরিতাপের বিষয় ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে এসব শিক্ষা
পুঁজিবাদিতা, ভোগবাদিতা আর পণ্যদাসত্ব বেনোজলের মতো ঢুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে। যার পরিণতি হলো হতাশা অস্থিরতা স্ট্রেস। বস্তুর প্রতি ক্রমবর্ধমান আসক্তি তৈরি হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই মিলছে না তৃপ্তি। লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের চক্করে ব্যক্তিগত জীবন হয়ে যাচ্ছে পাবলিক প্রপার্টি। বাড়ছে উদ্বেগ-বিষণ্ণতা। নেশা, এমনকি আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক পন্থায় মুক্তি খুঁজছে অনেক তরুণ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আত্মহত্যা-প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ১০ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে।  

তাহলে তরুণদের করণীয় কী?
১. লক্ষ্য নির্ধারণ : জীবনের একটি মহৎ লক্ষ্য নির্ধারণ করুন এবং লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগী হোন। আসলে অনেক তরুণেরই এখন জীবনের লক্ষ্য নেই। আবার অনেকের লক্ষ্য স্রেফ চাকরি বা পেশা। আসলে লক্ষ্য শুধু পেশা না, পেশার চেয়েও বড় কিছু। আপনি ডাক্তার হতে চান- লক্ষ্য হওয়া উচিত ভালো ডাক্তার হয়ে মানুষের কল্যাণ করা। এটা যদি করতে পারেন তাহলে অর্থ সম্মান-খ্যাতি-সবই আসবে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে।

২. ক্লাসে ১ম হোন: আপনি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সাবজেক্টে ভর্তি হয়েছেন সেখানে ১ম হওয়ার যোগ্যতাও আপর আছে। এখন প্রয়োজন এই যোগ্যতার ওপর আস্থা রাখা এবং ১ম হওয়ার জন্যে যা যা করণীয় তা করা। মনে রাখবেন, ক্লাসে ১ম হলে প্রশস্ত হয়ে যাবে আপনার সাফল্যের পথ। কারণ আপনার সিভিতে যখন রেজাল্টের ঘরে থাকবে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট তখন নিয়োগদাতারা একটু তো নড়েচড়ে বসবেনই!

৩. যোগাযোগ ও সংযোগায়ন: এটা খুবই প্রয়োজনীয় একটি গুণ। আপনার নেটওয়ার্কিং যত ভালো হবে তত তৈরি হবে নতুন নতুন সুযোগ। এজন্যে মানুষের সাথে মিশতে হবে, বাড়াতে হবে বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ।

৪. সেবাকাজে কিছু সময় ব্যয় করুন: সেবাকে নিছক ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ ভেবে অবজ্ঞা করবেন না। সাম্প্রতিককালের চিকিৎসাবিজ্ঞানী-মনোবিদদের চমকপ্রদ সব গবেষণা-প্রতিবেদনগুলো বলছে, ঘরের খেয়ে সত্যিই যারা বনের মোষ তাড়াতে পারেন, অর্থাৎ কোনোরকম প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই চারপাশের মানুষ ও সমাজের কল্যাণে নিয়মিত কাজ করে যান, তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা বাড়ে। কমে হতাশা-বিষণ্ণতা-একাকিত্বের অনুভূতি। তাদের পেশাজীবনেও সৃষ্টি হয় অনবদ্য সাফল্য-সম্ভাবনা।

৫. নিয়মিত মেডিটেশন করুন: মেডিটেশন আপনাকে রাখবে প্রশান্ত-প্রত্যয়ী, করবে লক্ষ্যাভিসারী। লক্ষ্য অর্জনে কখন কী করতে হবে তা বোঝার একটা সহজাত ক্ষমতা সৃষ্টি হবে। আপনি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবেন লক্ষ্যের পথে।

৬. সৎসঙ্ঘে একাত্ম হোন: সঙ্ঘে মেধার বিকাশ হয়। নিজের গুণ ও শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এজন্যে বলা হয়, ‘একা হলে ব্যক্তি, সঙ্ঘে এলে শক্তি!’ আপনি যদি সঙ্ঘে একাত্ম থাকেন তাহলে জীবনে চলার পথে পড়ে যেতে গেলে অজস্র হাত এগিয়ে আসবে আপনাকে তুলে ধরতে।

এএ

তাশফিয়া ইসলাম বিভা

আরও পড়ুন