ঢাকা, বুধবার, ২১ মে ২০২৫

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

মিতব্যয়িতার অভ্যাস শুরু পরিবার থেকে

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

প্রকাশ: ১৭:৪১, ২ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৭:৪২, ২ মে ২০২৫

মিতব্যয়িতার অভ্যাস শুরু পরিবার থেকে

একজন মানুষ যখন মিতব্যয়ী হয়, সে সঞ্চয় করতে পারে, সঞ্চয়ী হয়ে ওঠে। ফলে যে-কোনো অর্থনৈতিক চাপ সে সহজে নিতে পারে, যে-কোনো অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা তার জন্যে সহজ হয়। অন্যদিকে মানুষ যখন অপচয় করতে থাকে সে একদিকে যেমন শয়তানের ভাইয়ে পরিণত হয়, তার রিজিক কমতে থাকে। হয়তো তার কেনার সামর্থ্য থাকে কিন্তু প্রয়োজনের সময় যে-কোনোভাবেই হোক সে সেটা জোগাড় করতে পারে না। এটা অপচয়ের একটা বড় শাস্তি।

আসলে মিতব্যয়িতা হলো– অপচয় নয় আবার কৃপণতাও নয়। অর্থাৎ ব্যয়ে মধ্যপন্থা। প্রয়োজনে ব্যয় করবো কোটি টাকা কিন্তু অপ্রয়োজনে এক টাকাও নয়।

অনেকে আবার মনে করেন, মিতব্যয়ী মানুষ মানেই কৃপণ। না, একদমই না। মিতব্যয়িতা মানে হচ্ছে—সচেতনভাবে, পরিকল্পনা করে খরচ করা। আর কৃপণতা মানে—চাহিদা থাকলেও খরচ না করা, অন্যের প্রতি কৃপণতা করা। একজন মিতব্যয়ী মানুষ তার পরিবারের প্রয়োজন বোঝেন, গুণগত ভালো জিনিস কেনেন, অপচয় করেন না। 

একটা উদাহরণ দিই— কেউ যদি বাজারে যাওয়ার আগে লিস্ট করে নেন, বাড়িতে কী আছে সেটা দেখে তবেই কিনতে যান—তাকে আপনি কৃপণ বলবেন, নাকি সচেতন।

আল কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ২৬-২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- তোমরা সম্পত্তির অপচয় করবে না। নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি চূড়ান্ত অকৃতজ্ঞ।

রসূলুল্লাহ (স.) নিজেও মিতব্যয়ী ছিলেন। অল্পতেই সন্তুষ্ট ছিলেন।

আজকের আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বলছে— "Less is more." কম খরচ করলেই বেশি শান্তি পাওয়া যায়। অতিরিক্ত কেনাকাটার নেশা মানসিক উদ্বেগ বাড়ায়, অথচ পরিকল্পিত খরচ মানসিক প্রশান্তি দেয়। মানুষ যখন সামনে সহজ অপশন পায়, তখনই বেশি খরচ করে। কিন্তু পরিকল্পনা করে খরচ করলে তারা বেশি সন্তুষ্ট থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদে সফল হয়।

এক শিল্পপতি স্বাভাবিকভাবেই তিনি সন্তানদের পর্যাপ্ত পকেট মানি দিতেন। তো ছেলেরা যখন গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে তিনি তাদের ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “সারা জীবন তো তোমাদের আমি কম টাকা দেইনি। এখন হঠাৎ আমার একটু সমস্যা হয়ে গেছে। তোমাদের কাছে কার কি আছে আমাকে দাও।” দেখা গেল, বড় ছেলে যা দেয়া হতো তা সব খরচ করে ফেলেছে। কারণ সে কোন চিন্তাই করেনি, ভাবতো লাগলে বাবা দেবে। মেজ ছেলেকে দেখা গেল যে সে এত বেশি খরচ করেছে যে কিছু তো নাই উল্টো বন্ধুবান্ধবদের কাছে কিছু ঋণও করেছে। আর ছোট ছেলে বাবাকে বললো, “বাবা আগে তো বুঝিনি। তবে প্রয়োজনীয় খরচের একটা বাজেট করে বাকি টাকাটা আমি নিজের ব্যক্তিগত সঞ্চয় একাউন্ট করে প্রতি মাসেই বেশ কিছু সঞ্চয় করতাম। সেগুলো এত দিনে ভালো একটা পরিমাণ হয়েছে। কিন্তু তোমার যে বিশাল ব্যবসা, তার যে অর্থ দরকার তার তুলনায় তো সামান্য। তারপরও এটা তুমি নাও।” বলে সে মোটামুটি একটা অঙ্ক অর্থ তার বাবার হাতে তুলে দিলো।

তো বাবার উদ্দেশ্য ছিল তার ব্যবসার দায়িত্ব কোন ছেলেকে দেবেন তা নির্ধারণ করা। বাবা বড় দুই ছেলেকে বাদ দিয়ে ছোট ছেলেকে দায়িত্ব দিলেন।

অপচয় এবং অপব্যয় একটি দুষ্ট চক্র। এর ফলে জীবনে টেনশন ও হতাশা নেমে আসে। সুতরাং জীবনে প্রশান্তি এবং স্বচ্ছলতা চাইলে মিতব্যয়ী হতে হবে।

 বর্তমান সময়ে আমাদের পরিমিতির বড় অভাব হচ্ছে কেনাকাটায়। শুধু কিনতে থাকো , শুধু খাও, শুধু ভোগ করো, ঋণ করে হলেও করো। ঘরের আলমারিতে জমে থাকা এত কাপড় যে মনে হয় তা কোনো শোরুমের ডিসপ্লে শেলফ, জুতার ব্যাগে সারিবদ্ধ থাকে অর্ধশত জুতা-স্যান্ডেল, যার বেশির ভাগই থাকে অব্যবহৃত। তারপরও ছোট থেকে বড় সবাই নতুন জামা-কাপড়, শাড়ি, জুতা, ব্যাগ কেনার মহোৎসবে পরিবারের মানুষগুলো হয়ে পড়ে পাগলপ্রায়।

আসলে সন্তানরা মা-বাবা ও অভিভাবকেরা কী করে তা দেখে শেখে। এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে মা-বাবাকে।

 এছাড়া কিছু বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।

১. শিশু সন্তানের হাতে কখনো টাকা না দেয়া। সন্তানের কিছু প্রয়োজনে হলে অভিভাবকেরা নিজে কিনে দেয়া।

২. ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে চাওয়া মাত্রই দেয়ায় অভ্যাস না করা। তাকে কোনো কিছু পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে শেখান। তাহলে সে সংযমী হবে। অপচয় প্রবণতা দূর হবে।

৩. বোঝার সামর্থ্য হলে সন্তানকে পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য ও বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দিন। বিষয় ও বয়স বুঝে তাদেরকে পারিবারিক আলোচনায় অংশীদার করুন। সন্তানদের বুঝতে দিন কত কষ্ট ও মেহনত করে আপনি উপার্জন করছেন।

৪. ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে দানে উদ্বুদ্ধ করা। উপার্জিত অর্থের একটি অংশ দান করলে অপচয় এমনিতেই কমে যায়।

৫. মা-বাবা হিসেবে নিজেরা অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা, অতিরিক্ত বিলাসদ্রব্য এড়িয়ে চলা।

৬. খাবারের অপচয় রোধ করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার প্লেটে নেই। যা খেতে পারি না তা ডাস্টবিনে ফেলে দিই। ২০২৪-এ UNEP-এর ফুড ওয়েষ্ট ইনডেক্স রিপোর্টে বলা হয়, ২০২২ সালে বিশ্বে মোট খাবারের প্রায় ১৯৯ শতাংশ অর্থাৎ একশ কোটি টনের বেশী খাবার অপচয় হয়েছে যা দিয়ে আফ্রিকার প্রায় দুই বছরের খাবারের চাহিদা মেটানো যেতো। আসলে খাবার নষ্ট করার সময় গাজার শিশুদের কথা যদি একটু মনে করতে পারি তাহলে একাজ আমরা করতে পারবো না।

৭. জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধ করতে হবে। হাতমুখ ধোয়ার সময়, শেভ করতে গিয়ে বা রান্নার সময় সবজি ধুতে গিয়ে হয়তো কলটা ছেড়েই রাখি। হয়তো ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম। কোনো কারণে উঠে গেলাম এবং গিয়ে কোনো জরুরি কাজে আটকে গেলাম। আর ঐ দিকে টিভি চলছে, পাখা ঘুরছে, এটাও অপচয়।

৮. যেখানে এক বালতি পানি দিয়ে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ গোসল সারতে পারে। সেখানে শাওয়ার ছেড়ে বালতির পর বালতি পানি নষ্ট করে অনেকেই গোসল সারেন।

৯. প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিন অহেতুক অপচয় রোধ করবেন। বাড়িতে তিন-চারটি ঘর হলে যে ঘরটিতে আছেন, সেই ঘরটি ছাড়া অন্য ঘরে বাতি ও ফ্যান বন্ধ রাখুন। দিনের বেলায় যতটা কম সম্ভব আলো জ্বালান। ঘরের দেয়াল, ছাদ, পর্দা ও আসবাবপত্রে সাদা ও উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ঘরকে উজ্জ্বলতর করে। এতে অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়ে থাকে।

এসি চালানোর ব্যাপারে সতর্ক হোন। এমনকি এই প্রচণ্ড গরমেও সারারাত এসি চালাবেন না। বরং ঘণ্টা তিনেক এসি চালিয়ে ঘর ঠাণ্ডা করে নিয়ে, ফ্যান চালিয়ে দিন। আগে থেকে পরিকল্পনা করে একবারে অনেকগুলো কাপড় একসঙ্গে ইস্ত্রি করুন। বিদ্যুৎ বাঁচবে অনেকটা। নোংরা টিউবলাইট এবং বাল্ব প্রায় ৫০ শতাংশ আলো শোষণ করে নেয়। আপনার টিউবলাইট এবং বাল্ব নিয়মিত পরিষ্কার করুন। এলইডি আলো প্রচুর বিদ্যুৎ বাঁচায়। বাড়ির আলোগুলো একে একে বদলে এলইডি করে নিন।

মিতব্যয়িতা হতে সাহায্য করে মেডিটেশন
মেডিটেশন আমাদের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়। আমরা যখন নিয়মিত মেডিটেশন করি, তখন impulsive decision (তাৎক্ষণিক খরচ, হঠাৎ কেনাকাটা) কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ: আপনি হয়তো আগে দেখতেন কিছু দেখেই কিনে ফেলছেন। মেডিটেশনের ফলে আপনি নিজেকে থামাতে শেখেন—“এটা সত্যিই দরকারি কিনা, সেটা ভেবে নিই।”

এএ

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

আরও পড়ুন