মুশরিফিন আনোয়ার
প্রকাশ: ১৩:১৮, ১ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৩:৫৮, ৫ মে ২০২৫
মাহাদী রহমান বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। বাস আসতে দেরি হওয়ায় সে ভাবল বাথরুম সেরে নেবে। পাবলিক টয়লেটে ঢুকতেই তার মেজাজটা সপ্তমে চড়ে। ব্যবহার অনুপযোগী নোংরা টয়লেট; যেহেতু নিজের না তাই ব্যবহার শেষে কেউ ফ্লাশ করে না। ‘মানুষের কমনসেন্স বলতে কিছু নেই’-ভাবতে ভাবতে কোনোমতে বাথরুম সেরেই মাহাদী বেরিয়ে গেল কমোডে পর্যাপ্ত পানি না ঢেলেই।
বাস এসেছে; মাহাদী ‘বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার কোনো নিয়মকানুন নেই’ বলে গজ গজ করতে করতে কিউ ছাড়াই কাউন্টার থেকে টিকেট কাটল। অথচ নিয়ম হলো, লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটতে হবে।
মাহাদী বাসে উঠে সিটে বসেই স্মার্টফোন অন করল। অনলাইন নিউজ পোর্টালের একটা লেখা নজর কাড়ল তার। এক জাপানি শিশু তার পোষা কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিল। কুকুরটা পথে টয়লেট করলে শিশুটি নিজেই বেলচা নিয়ে ময়লা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে। রাস্তাটা ছিল ঝকঝকে তকতকে।
মাহাদী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভাবছিল, ওদের রাস্তা কত পরিষ্কার আর বাংলাদেশের পথঘাট কী নোংরা! অথচ একটু আগেই সে কলা খেয়ে বাসের জানালা দিয়ে রাস্তার ওপর ছুঁড়ে ফেলেছিল খোসাটা।
মাহাদী জানে জাপানিরা খুব নিয়মানুবর্তী এবং আত্মসচেতন জাতি। তার মনে পড়ল, বিশ্বকাপে জাপান ফুটবল ম্যাচে হারার পরও জাপানি সমর্থকরা স্টেডিয়াম পরিষ্কার করে এসেছিল। নিউজটা দেখে তার আক্ষেপ হচ্ছিল, ওরা কত সভ্য জাতি! আর আমরা…! অথচ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবায় যে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার তাগিদ সে কখনও অনুভব করেনি।
মাহাদী অসৎ সরকারি চাকুরিজীবীদের মুণ্ডুপাত করেন নির্দ্বিধায়; অথচ ভুল করে রিসিভ করা ১০০০ টাকার জাল নোট আরেকজনকে গছিয়ে দেয় অবলীলায়। আসলে বিদ্যমান অসঙ্গিতগুলোর জন্যে দায়ী এমন অজস্র ‘মাহাদী’! অনেকেই অন্যের দোষ ধরতে পছন্দ করেন; ভাবেন ‘অমুক’সমস্যা ‘তার’কারণেই হলো! অথচ নিজের ভুলটা দেখেন না বা দেখেও উপেক্ষা করেন।
একই অবস্থা দেশ নিয়ে ভাবনাতেও। দেশের নানাবিধ সমস্যাই শুধু চোখে পড়ে। কিন্তু সমস্যা নিরসনে নিজের করণীয়টুকু নিয়ে ভাবি না। ফলে উন্নতিও আসে না। উদাহরণস্বরূপ, মাহাদী টয়লেট শেষে ফ্লাশ করে বেরুলেই তো পরের ব্যবহারকারী পরিষ্কার কমোড পেত! কলার খোসা ডাস্টবিনে ফেললে অন্তত একটা খোসা রাস্তায় কম জমত। স্বেচ্ছা পরিচ্ছন্নতা সেবায় অংশ নিলে আরেকটু পরিচ্ছন্ন হতো সড়ক। কিউ ভঙ্গ করে টিকেট কাটার অনিয়মের শুরুটা হয়ত তাকে দিয়েই শুরু হয়েছিল! নিজের ভুলে হস্তগত জাল নোট আরেকজনকে না দিলে আরেকটা অসৎ কাজ অন্তত হতো না।
আসলে এক মাহাদী নয়, এমন অজস্র ‘মাহাদী’ই দায়ী এই অসঙ্গগতির জন্যে। যেখানে প্রত্যেকেই ভাবছে, আমি একা বদলালেই বা কী হবে! বা আমি একা কজনকে শোধরাব? আসলে অন্যকে শোধরানো আপনার কাজ নয়, সেটা হয়ত পারবেনও না। তবে পারবেন নিজেকে শোধরাতে। প্রত্যেকেই যখন নিজেকে শোধরানোর দায়িত্বটুকু সহীভাবে পালন করবে তখনই আসবে কাঙ্ক্ষিত বদল।
আবার এক আপনার দেখিয়ে দেয়া পথে হাঁটতে পারে অনেকে। হ্যাঁ, ভালো কাজও ‘সংক্রামক’ হতে পারে! এর অসংখ্য নজির আপনিও হয়ত দেখেছেন। করোনা মহামারির সময় যখন বহু মানুষ উপার্জনহীন হয়ে পড়েছিল, সুপারশপগুলোতে ‘প্যানিক বায়িং’ হচ্ছিল হরদম, তখনকার সময়ের একটি ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুপারশপে ক্রেতারা কেনাকাটা শেষে লাইনে দাঁড়িয়ে বিল পরিশোধ করছিল। এক কাস্টমার তার বিলের সাথে অতিরিক্ত ৫ ডলার তার পরের ক্রেতার জন্যে নীরবে রেখে গেলেন। পরের ক্রেতার আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তিনি সেটা তো নিলেনই না, উল্টো আরো ৫ ডলার রেখে গেলেন তার পরের ক্রেতার জন্যে। একই কাজ করলেন তার পরের ক্রেতাও। এভাবে অল্প সময়ে সুপারশপ প্রতিনিধির হাতে জমল বড় অংকের অর্থ। শুরুটা করেছিল কিন্তু একজন!
আপনার তরফে ছোট্ট একটু বদল পরিবর্তন সূচিত করতে পারে সামগ্রিক সচেতনতায়। ১৯৫২ সালে জাপানের কোজিমা দ্বীপের ম্যাকাকে শ্রেণির বানরের ওপর বিজ্ঞানীরা একটি গবেষণা চালান। এই বানরগুলোকে মিষ্টি আলু খেতে দেয়া হতো। সৈকতে পড়ে থাকায় আলুগুলোতে বালি লেগে থাকত। এই বালিমিশ্রিত আলু খেতে ভালো না লাগলেও উপায় কী? বানরগুলো এভাবেই আলু খাচ্ছিল। একদিন দেড় বছর বয়সী একটি বানর দেখল সাগরের পানিতে আলু ধুয়ে নিলেই সেগুলোতে বালি থাকে না, মজা করে আলু খাওয়া যায়। টেকনিকটি সে তার বন্ধুদের শেখালো। ছোটদের কাছ থেকে শিখল বড় বানরগুলোও। এভাবে আলু ধুয়ে খাওয়ার পদ্ধতি জানা বানরের সংখ্যা বাড়ছিল। তবে তা ধীরে ধীরে। কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বানর যখন পদ্ধতিটি শিখল তখন ব্যাখ্যাতীত উপায়ে ঘটল এই শিক্ষার অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ; অল্প সময়ের মধ্যে দেখা গেল কোজিমা দ্বীপের সকল বানর আলু ধুয়ে খাচ্ছে! সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, কিছু দিনের মধ্যেই আলু ধোয়ার অভ্যাস ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশের দ্বীপগুলোর বানরের মধ্যেও, যাদের সাথে কোজিমা দ্বীপের কোনো যোগাযোগ নেই! বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘The Hundredth Monkey Phenomenon’ তত্ত্ব দিয়ে। সংক্ষেপে বললে, যখন কোনো চেতনা একটি তাৎপর্য সংখ্যক মানুষ গ্রহণ করে তখন ঘটে চেতনাগত বিস্ফোরণ। চেতনাটি তখন পরিণত হয় Collective Consciousness বা সামগ্রিক চেতনায়। ধরাছোঁয়া ছাড়াই তা ছড়িয়ে পড়ে জন থেকে জনে। হাজার হাজার, লাখ লাখ এমনকি কোটি কোটি মানুষ গ্রহণ করে সেই চেতনা। শুরুটা হয় কিন্তু একজনের হাত ধরেই!
‘আরব বসন্ত’-এর কথাই ধরা যাক। তিউনিসিয়ার সিদি বৌজিদ শহরে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে গায়ে আগুন দিয়ে মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামে এক যুবক রাষ্ট্রীয় অনিয়ম আর জুলুমের প্রতিবাদ করেন। একক প্রতিবাদ দ্রুতই পরিণত হয় লাখো কোটি মানুষের প্রতিবাদে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশ এবং তারপর পুরো আরব বিশ্বে। পরবর্তী কয়েক বছরে দশকের পর দশক ধরে চলা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে তিউনিসিয়া, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়াসহ ৯টি দেশে। এতবড় ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাতও কিন্তু মাত্র একজনের হাত ধরে!
সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোঠা সংস্কারের দাবিতে দেশের তরুণ প্রজন্ম নেমে আসে রাজপথে। ক্রমেই তা রূপ নেয় শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে। দেশের তরুণ প্রজন্ম দেখিয়েছে, কীভাবে পরিবর্তন আনতে হয়। তারা দেখিয়েছেন, দেশকে পরিবর্তনের রূপরেখায় আনার জন্য জরুরি সদিচ্ছা। আমাদের পক্ষেও সামগ্রিক বদল আনা সম্ভব। আমাদের জাতিও সব পারে। তাই আসুন প্রথমে ‘আমাকে’বদলাই। নিজেকে বদলাতে অনেক বড় বড় কাজ করার প্রয়োজন নেই। মাত্র একটি বিষয় যদি মাথায় রাখলেই আপনি বদলাবেন আর আপনার হাত ধরে বদলাবে দেশ। আর তা হলো নিজের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করা।
আপনি কি শিক্ষার্থী? তাহলে জ্ঞানার্জনে আন্তরিক হোন, পড়ালেখা করুন ক্লাসে ১ম হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। যদি শিক্ষক হন তো নিজের জ্ঞানকে আরো বিকশিত করুন। আর তা সঞ্চারিত করুন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ডাক্তার হলে রোগীর সেবাকেই ব্রত হিসেবে গ্রহণ করুন। যদি সরকারি চাকুরিজীবী হন তো দুর্নীতি বর্জন করে মানুষকে দিন সর্বোত্তম সেবা। আর ব্যাংকার হলে তো কথাই নেই। মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি সুযোগতো আপনার রয়েছে। ভাবছেন আমি তো গৃহিণী, আমি কীভাবে দেশ বদলে অবদান রাখব? পরিবার ভালো হলে ভালো হয় সমাজ তথা দেশ। তাই ঘরটাকে সুন্দরভাবে সামলানো মানেই দেশ গোছানো!
যে পেশায় যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, সচেতন হোন নিজের দেহমনের যত্নায়নে। নিজের যত্ন নেয়াও কিন্তু দেশপ্রেমের পরিচায়ক! কারণ নিজে সুস্থ না থাকলে আরেকজনকে সেবা দেবেন কীভাবে?
এভাবে আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজের যত্ন নেই, নিজের কাজ করি সবচেয়ে ভালোভাবে, মেধাকে পরিণত করি সেবায় তাহলেই বদলে যাবে দেশ। পরিণত হবে স্বর্গভূমি বাংলাদেশে।
ইনশাআল্লাহ্ সব সম্ভব!
opinion mushrifin