দি ব্যাংকার ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮:৪২, ২ মে ২০২৫
বলা হয় কিছু ঋণ অত্যাবশ্যকীয় এবং কিছু ঋণ বিলাসী জীবনযাপনের রসদ—এ দুটোর মধ্যেই পার্থক্য রয়েছে। বিষয়টি বোঝার জন্য কিছু দৃশ্যপট দেখে নেওয়া জরুরি।
ঘটনা ১ : স্কুলজীবনের কজন বন্ধু একসঙ্গে একটি মুরগীর খামার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমদিকে ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু ব্যবসার পরিসর বাড়বে বলে পরিচিত কজন তাদের ব্যাংক থেকে সিসি লোন নিতে উৎসাহ দিল। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিল। সে ঋণের টাকায় খামারের আয়তন বাড়ল। কিন্তু আকস্মিকভাবে বার্ড ফ্লুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ব্যবসার মন্দার পাশাপাশি ঋণের কিস্তি শোধের চাপ। সময়মতো কিস্তি শোধ করতে না পারায় একদিন ব্যাংকের চিঠি আর উকিলি নোটিশ এলো। আচমকা এ বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য সস্তা দামে খামারের জমি বিক্রি করল এবং ঋণের বাকি টাকা শোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হলো।
ঘটনা ২: নিজের বিয়ের আগে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয় এক ব্যাংকার। তার ধারণা ছিল, বিয়েতে খরচের পর শেয়ার বাজারেও বিনিয়োগ করে তিনি অনেকটুকু অর্থ আদায় করে নিতে পারবেন। শেয়ার বাজারে ধস নামতেই তাকে আরেক ব্যাংকের কাছে ঋণ নিতে যেতে হয়। ঋণের কিস্তি চালাতে গিয়ে শুধু ব্যাংক নয়, বন্ধুবান্ধব ও আত্নীয়দের কাছেও দেনা বাড়ে। নিজের নতুন সংসারের খরচ সামলাতে না পেরে অশান্তিও দিন দিন বাড়ছে।
ঘটনা ৩ : এক ব্যক্তি তার বাড়িতে প্রায়ই ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। তার আত্নীয়রা আনন্দের সঙ্গে যোগ দিতেন। এ ব্যক্তির জীবন ও উচ্চপদস্থদের সাথে ওঠাবসার বিষয়টি তার পরিবার-স্বজনদের জন্য গর্বের কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু পরিবার-পরিজনের কারোই জানা ছিল না, তার এ রাজসিক জীবনযাপনের পেছনে কোটি টাকার ব্যাংক ঋণই ছিল চালিকাশক্তি। সময়ের সাথে সাথে পাওনাদারদের চাপ বাড়ছিল। ঋণশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তার বিলাসবহুল রসদ জব্দ করা হয়। আচমকা লজ্জার এক জীবন শুরু হয় তার। মানসিক চাপ ও শারীরিক অসুস্থতায় একদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার কুলখানিতে গ্রামের সামান্য কজনই আসেন। অনেক আত্নীয় সেখানে যোগও দেয়নি। তারা এ আত্নীয়র পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করছিল।
তিনটি আলাদা ঘটনা। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেকের জীবনে ঋণ, কিস্তি, ক্রেডিট কার্ড নানাভাবে মারণফাঁদে পরিণত হচ্ছে। ঋণ, কিস্তি ও ক্রেডিট কার্ডের বিল শোধ করতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কিন্তু ঋণদাস হওয়ার প্রক্রিয়াটিকেই এখন অনেক ব্যাংক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
ঋণগ্রস্ত মানুষের জীবনে নেতিবাচক পরিণতি
ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের একটি সমীক্ষা জানায়, ইংল্যান্ডেই অন্তত এক লাখের বেশি মানুষ প্রতি বছর ঋণশোধ করতে না পেরে আত্নহত্যার চেষ্টা করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও ঋণের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ে। এজন্য মার্কিন সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে ঋণ সম্পর্কের ঘাতক। অন্যদিকে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় ক্রেডিট কার্ডধারীদের ঋণদাস বলা হয়।
শুভঙ্করের ফাঁকি ক্রেডিট কার্ড
দেশে বেড়েছে ক্রেডিট কার্ডধারীদের সংখ্যা। ফলে দেশে নতুন আগ্রাসনের নাম ঋণ। ২০১৫ সালে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে কীভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাড়ানো যায় এবং বাকিতে পণ্য কেনার অভ্যাসকে অনেক জনপ্রিয় করা যায়—এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
তাদের ভাষ্য, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে ঢাকার মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান জনগোষ্ঠীর আকার ২০১৫ সালের দ্বিগুণ হবে বলে জানায়। রাজশাহী ও বরিশালে একাধারে তিন গুণ এবং খুলনায় তা বাড়বে ছয় গুণ। প্রতিবেদনে বলা হয়, উদীয়মান ধনী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে আশাবাদী মানুষ বেশি হওয়ায় তারা এ প্রাক্কলন করেছে।
তারা এও জানায়, বাংলাদেশের মানুষ ঋণ শোধ করার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। দেশে ঋণদাস বাড়ার পেছনে ক্ষুদ্রঋণের প্রচলনকারীরা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। ঋণগ্রস্ত মানুষ তার ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপে মিথ্যা বলে আর এক সময় সে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ঋণের চাপে সৎ থাকতে না পেরে তিনি নৈতিক অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে যান।
শুভঙ্করের ফাঁকির অপর নাম ক্রেডিট নাম
ক্রেডিট কার্ডে যে অর্থ থাকে সেটি আপনার নিজের অর্থ নয়। মূলত কিছু শর্ত পূরণ করলে ব্যাংক আপনাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ আগাম ঋণ দিয়ে থাকে। তবে এ ঋণ দিয়ে আপনি শুধু পণ্যসামগ্রী কিনতে পারবেন। আর যদি অর্থ উত্তোলন করে থাকেন তাহলে তানতে হবে বাড়তি সুদ। ক্রেডিট কার্ডের অনেকগুলো খরচ আছে।
ক্রেডিট কার্ড বিলাসী পণ্য কেনার বিষয়ে মানুষকে অভ্যস্ত করে। বিভিন্ন ধরনের হোম এপ্লায়েন্স, স্মার্ট গেজেট কিংবা বাড়ির জন্য বিলাসী পণ্য কেনার জন্য ক্রেডিট কার্ড অনেকের জন্যই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কেনার সামর্থ্য না থাকলেও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কিনে পরবর্তী সময় কিস্তিতেও শোধ করা যায়। এমনটি হলে অনেক সময় পরিচিত কারো কাছে ঋণের জন্য দ্বারস্থ হতে হয় না।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। যদি একটি ওয়াশিং মেশিনের দাম ৫০ হাজার টাকা হলে তা মিনিমাম পে-এবল পলিসিতে ৫% সুদেও যদি কেনেন তাহলে কার্ডে এ ঋণ শোধ করতে প্রায় ১৮ বছর লাগবে। এই দীর্ঘ সময়ে আপনাকে শোধ করতে হবে অন্তত ১৮ লাখ টাকা।
আধুনিক সময়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে ক্রেডিট কার্ড অনেক আকর্ষণীয়। তারা এটিকে স্ট্যাটাস সিম্বল মনে করে। কিন্তু বাস্তবে ক্রেডিট কার্ড এক ধরনের দাসত্ব এবং অর্থের বাড়তি অপচয়।
ক্রেডিট কার্ড যখন ডিসক্রেডিট
বিভিন্ন আয়োজনকে কেন্দ্র করে ক্রেডিট কার্ডে নানা ছাড় ও সুযোগ-সুবিধার আয়োজন থাকে। আসছে ঈদুল আজহা। এ সময় আকর্ষণীয় মূল্যে আর কিস্তিতে অর্থাৎ বাকিতে ফ্রিজ কিনতে প্রলুব্ধ করা হয় ক্রেতাদের। কিন্তু এসবের ফলে কোরবানির পবিত্রতা ও রহমত-বরকত থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আপনি নিজেই।
আপনি কোরবানি করছেন আল্লাহর নামে। কিন্তু মাংস রাখার জন্যে যখন কিস্তিতে ফ্রিজ কিনছেন, আপনার জীবনে সুদ প্রবেশ করছে। আবার প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ নিয়ে কোরবানি করার মানসিকতাও অনেকের মধ্যে দেখা যায়। সুদের হার কম বা বেশি যা-ই হোক, সুদসহ আসল শোধ করতে হবে—এটাই নিয়ম।
শুধু তা-ই নয়, কিস্তিতে ভোগ্যপণ্য কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করে না; বরং এটা নগদে নিজের উপার্জিত টাকায় কিনতে পারার অযোগ্যতাই প্রকাশ করে। উপার্জন না করে ব্যয় করা অসম্মানের।
এ বিষয়ে ধর্ম কী বলে?
ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারে ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন)-এর ২০০০ সালের ফতোয়া, ক্রেডিট কার্ডে যদি সুদ আরোপ করার ব্যবস্থা থাকে, সুদ আরোপ হওয়ার আগেই আসল শোধ করে দিলেও এটা অনুমোদন করা যায় না।
সনাতন ধর্মমতে, ইহলোকে উত্তমর্ণের কাছে সকল ঋণশোধ করার শক্তি দাও। তোমার প্রাসাদে আমায় সকল ঋণ থেকে মুক্ত করো। ঋণ নিমিত্ত নরকপাত থেকে আমায় মুক্ত করো।... [অথর্ববেদ : শ্লোক ১১৭-১৮-১৯]
বাইবেলেও ঋণ নিষিদ্ধ। ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে সেইন্ট অ্যামব্রোস বলেন, সুদি ব্যবসা মূলত ঋণী ব্যবসা এবং তা ডাকাতি কিংবা খুন করার সমতুল্য।
তাই ঋণ কিস্তি ও ক্রেডিট কার্ডের এ অভিশাপ থেকে বাঁচতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিজের জীবনে অর্থায়নের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। জীবনে মানি ম্যানেজম্যান্ট ও ব্যাংকিং ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে সচেতনতাই পারে আপনাকে ঋণদাসত্ব থেকে মুক্ত রাখতে।