ব্যাংকার প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০:৩২, ২৪ মে ২০২৫ | আপডেট: ২০:৩৩, ২৪ মে ২০২৫
‘বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি নীতিমালা: এলডিসি পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয়তা এবং চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে এবং এলডিসি পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমদানি-রপ্তানি নীতিমালার পুনঃমূল্যায়ন জরুরি।
আজ শনিবার (২৪ মে) রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যকার কাঠামোগত সংস্কার জরুরি, তবে যে গতিতে বর্তমানে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। সত্যিকারে শিল্পখাতসহ অন্যান্য সেক্টরে আমাদের কোনো দীর্ঘমেয়াদে রোডম্যাপ নেই, যা হতাশার বিষয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি সরকারের সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, সকল বন্দর সমূহ অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড, তাই এগুলোর ব্যবস্থাপনা সচল রেখে নির্বিঘ্নে কার্যক্রম পরিচালনা করা একান্ত অপরিহার্য। ব্যবসায়ী সমাজের দাবি সমূহ যৌক্তিক আকারে সরকারের নিকট উপস্থাপনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বেসরকারি খাতই আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশকে এলডিসি উত্তরণ করতেই হবে, এখান থেকে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের উচ্চ মানের তৈরি পোষাক পণ্য, ঔষধ এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের উপর বেশি হারে মনোযোগী হতে হবে।
তিনি বলেন, এলডিসি পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সকলের অংশগ্রহণে অতিদ্রুত একটি জাতীয় ডায়ালাগ আয়োজন করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের মানবসম্পদ, শিল্পকারখানা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে, এগুলোর মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধিকল্পে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
ইপিবি’র ভাইস-চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নগদ প্রণোদনার চাইতে কার্যকর নীতি সহায়তাই মূল হিসেবে কাজ করবে। পণ্য বহুমুখীকরণের জন্য নন-ট্রেডিশনাল খাতের উপর জোর দিতে হবে।
তিনি বলেন, বাণিজ্য নীতিমালার সংস্কার, কমপ্লায়েন্স ও স্ট্যান্ডার্ড এবং বেসরকারিখাতের প্রস্তুতি- ৩টি বিষয় নিয়ে সরকার কাজ করছে। তৈরি পোষাক খাতে ম্যান মেইড ফাইবার ব্যবহারের জন্য বেসরকারিখাতে এগিয়ে আসার জন্য তিনি উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি আরও বলেন, যথাযথ অবকাঠামো, জ্বালানি নিরাপত্তা, আর্থিক ও নীতি সহায়তা এবং লজিস্টিক সেবা নিশ্চিত করতে পারলে আগামী ২-৩ বছরে তৈরি পোষাক খাত হতে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।
এনবিআর সদস্য (কাস্টমস) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৯৩ সাল হতে এনবিআর এসআই কোডা-সহ রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য অটোমেটেড ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এলডিসি পরবর্তী নেগোশিয়েশনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিখাতের প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানি শুধু একটি পণ্যে তৈরি পোষাকরে উপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক দর কাষাকষিতে আমরা পিছিয়ে পড়ি। তিনি উল্লেখ করেন, সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়ারহাউস চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সবাইকে এ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি আরো বলেন, এনবিআর ইলেকট্রনিক ডাটা এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে, যেটি চালুর হলে ব্যবসায়ীরা আরো স্বল্প সময়ে আমদানিকৃত পণ্য ছাড় করতে পারবেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শুল্ক ও শুল্কের হার বেশি। এছাড়াও আমরা এখনও আমদানি করের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। রাজস্ব খাতে সংস্কারের অভাব এবং প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে কর বৃদ্ধিতে সরকারের ব্যর্থতার ফলে পরোক্ষ কর ও আমদানি করের উপর ব্যাপক নির্ভরতা দেখা দিচ্ছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি অনুসারে, আমাদেরও রপ্তানি পণ্যের স্বল্প বৈচিত্র্য, সীমিত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং বাণিজ্যের সুবিধার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসহ শুধু তৈরি পোষাক খাতের দ্বারা প্রভাবিত একটি রপ্তানি ভিত্তিকে সমর্থন করার জন্য মূলত নগদ এবং কর রিটার্নের প্রণোদনার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
অপরদিকে, আমদানি নীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ তার প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে উচ্চতর শুল্কসহ কোথাও জটিল প্যারা-ট্যারিফ ব্যবস্থা অনুসরণ করছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায়, এটি বাণিজ্যিক নীতি, গতিশীল শুল্ক সমন্বয়, নীতিগুলোর মধ্যকার কার্যকর সমন্বয় এবং আগ্রহী পক্ষগুলোর অংশগ্রহণের একটি সমন্বিত কাঠামো প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও ক্রমান্বয়ে শুল্ক হ্রাস, আমদানি নীতির আধুনিকীকরণ, শুল্ক পদ্ধতির সরলীকরণ, বাণিজ্যের সুবিধার উন্নতি, অটোমেশনের উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, চামড়া, ঔষধ, পাটপণ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রভৃতি পণ্যসমূহের রপ্তানির সম্ভাবনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। অপরদিকে মোট রপ্তানি ৮৪ শতাংশ তৈরি পোষাক ও সুনির্দিষ্ট কিছু বাজারের উপর নির্ভরশীল।
বিদ্যমান বাস্তবতায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের আমদানি-রপ্তানি নীতিমালার পুনঃমূল্যায়নের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তাসকীন আহমেদ।
তিনি আরো বলেন, আমদানি পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার পাশাপাশি শুল্ক ও ট্যারিফ কাঠামোর দক্ষ ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। এছাড়াও শিল্পখাতে নিরবচ্ছিন্ন ও অনুমেয় মূল্যে দীর্ঘমেয়াদে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের তাগিদ দেন তাসকীন আহমেদ।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের জয়েন্ট চিফ (ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন ডিভিশন) মো. মসিউল ইসলাম, বেসিস’র সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর, ডেল্টা ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাপী’র সেক্রেটারি জেনারেল ডা. মো. জাকির হোসেন এবং ফকির ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ অংশগ্রহণ করেন।
উন্মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই সাবেক পরিচালক এ কে ডি খায়ের মোহাম্মদ খান, বশির উল্ল্যাহ্ ভূইয়্যা, যুগ্ম-আহ্বায়ক সালাহউদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
ডিসিসিআই জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাসহ সরকারি-বেসরকারিখাতের স্টেকহোল্ডাররা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এএ
ব্যাংকার প্রতিবেদন