ব্যাংকার প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১:৪৩, ২১ জুন ২০২৫ | আপডেট: ২১:৪৩, ২১ জুন ২০২৫
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির উদ্যোগে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে ‘বাজেট বিতর্ক : প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ’ শীর্ষক সেমিনার এবং নীতিবিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার (২১ জুন) ঢাকার সিরডাপ অডিটোরিয়ামে এই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্। কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন মডারেটর হিসেবে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।
উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বর্তমান বাজেটটি একটি রাজনৈতিক শূন্যতার বাজেট, যেখানে একই সাথে সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং লুণ্ঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত রাজনৈতিক সরকারসমূহের দুর্নীতির চক্রের পরিধি ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। তারা চায় তাদের তৈরি টেমপ্লেটটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার অনুসরণ করবে।
এসময় তিনি তার অধীন মন্ত্রণালয়সমূহের সাম্প্রতিক কিছু অর্জন, চলমান কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ নদীপথ সংস্কার, অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র বন্ধ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও গ্রাহক পর্যায়ে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প সম্প্রসারণ উল্লেখযোগ্য।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ্ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত বাজেট আপাতদৃষ্টিতে গতানুগতিক মনে হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
আলোচনা পর্যায়ে ঘোষিত বাজেটের ৯টি দিক নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী ও নীতিনির্ধারকগণ।
বাজেট প্রবন্ধে ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির ঘোষিত বাজেটের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের দিকটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক মো. গুলজার নবী বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান জিডিপির আয়তন ৪৬৭ বিলিয়ন উল্লেখ করে সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং তৈরি পোশাক খাতের অবদানকে তুলে ধরেন তিনি।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শাফিউন নাহিন শিমূল প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের উদাহরণ টেনে স্বাস্থ্য বাজেটকে খাতওয়ারি খরচ হিসেবে চিন্তা না করে মানবসম্পদ উন্নয়নের একটি স্মার্ট বিনিয়োগ হিসেবে গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এক্ষেত্রে ঘোষিত বাজেটের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.৭ শতাংশকে অপ্রতুল মনে করেন।
বাজেটে শিক্ষাখাতের বরাদ্দ নিয়ে বিশ্লেষণ করে বিআইডিএস’র গবেষণা পরিচালক জুলফিকার আলি মনে করেন, শিক্ষা ও কর্মখাতের যে অসামঞ্জস্য বিরাজমান তা দূরীকরণে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় আরো বরাদ্দ দেওয়া উচিত। তাছাড়া বর্তমান সরকারের উদ্যোগে শিক্ষা কমিশন না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বাজেটের কয়েকটি খাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাছাড়া বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেসরকারি খাতে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ সমস্যা তৈরি করবে।
জাতীয় বাজেটকে রাজনৈতিক সংগ্রামের ফসল হিসেবে অভিহিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি জনগণের অর্থের ওপর জনগণের মালিকানা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন এবং বাজেট নিয়ে সংসদীয় কমিটির আলোচনা ও মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
প্যানেল আলোচনা পর্বে বিআইডিএস’র মহাপরিচালক অধ্যাপক এ কে এনামুল হক গতানুগতিকতা বিবর্জিত সুচিন্তিত বাজেট নীতির মাধ্যমে বিনিয়োগের সাথে উদ্ভাবনের সমন্বয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
আইসিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যথাযথ সংস্কার ছাড়া ট্যাক্সের অনুপাত বৃদ্ধি পেলে তা শুধু দুর্নীতি ও অদক্ষতার অর্থায়নে পরিণত হবে। অর্থবাজারের সীমানা পেরিয়ে পুঁজিবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
বাজেটের রাজনৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি এর চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কর্তৃক সাংবিধানিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দখল ও লুণ্ঠনের অপসংস্কৃতির প্রতি আলোকপাত করেন। সংকুচিত মুদ্রানীতির প্রভাব সামাল দিতে বিনিয়োগের পূর্বশর্তগুলো পূরণ না হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, দেশের প্রতি ভালবাসা ও দায়বদ্ধতা ছাড়া কোনো বাজেটই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অরাজনৈতিক হওয়ায় বাজেটের রাজনৈতিক আলোচনা কিছুটা নিরর্থক। তবে এই বাজেট ও এর বাস্তবায়ন গবেষণার বিষয় হতে পারে যা সময়ের দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
সরকারি সেবা নিতে ঘুষ দিতে হলে জনগণ কেন কর দিতে চাইবে সেই প্রশ্ন রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক অতনু রব্বানী। সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি ব্যতীত রাজস্ব বৃদ্ধি ফলপ্রসূ হবে না বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন।
এএ
ব্যাংকার প্রতিবেদন