অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান
প্রকাশ: ০০:১১, ৬ মে ২০২৫ | আপডেট: ০০:১১, ৬ মে ২০২৫
ইসলাম অর্থ সম্পদ অলসভাবে জমিয়ে রাখা পছন্দ করে না। বরং ইসলাম অর্থ সম্পদকে আর্থ-সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে অর্থের উৎপাদনশীল ব্যবহারের প্রতি জোরালো তাগিদ দেয়। ইসলাম যে সব সম্পদ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ যোগ্য বা প্রবৃদ্ধির যোগ্য সে সম্পদের উপর যাকাত ফরজ করেছে, চাই সে সম্পদ কোনো কারবারে বিনিয়োগ করা হোক বা অকেজো ফেলে না রেখে যাকাত দিতে হবে। যাকাতের সৌন্দর্য এতে যে, যাকাত পুঁজিকে অলসভাবে বেকার ফেলে রাখার সুযোগ দেয় না। যাকাত পুঁজিপতিদেরকে বাধ্য করে যেন তারা তাদের পুঁজিকে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ না রেখে উৎপাদনশীল কারবারে বিনিয়োগ করে। যাতে সাধারণ লোকদের রোজগারের পথ খোলাসা হয়, আর তাদের সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং জীবন মানের উন্নতি সাধিত হয়।
মহানবি সা. এতিমের অভিবাবকদেরকে এতিমদের সম্পদ অনুৎপাদনশীলভাবে ফেলে না রাখার আদেশ দিয়েছেন। যাতে তা ধীরে ধীরে খরচ হতে হতে এক পর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে না যায়। এ প্রসঙ্গে মহানবি সা. বলেন, “সাবধান! তোমাদের মধ্যে যে কেউ এমন কোনো এতিমের অভিভাবক হবে যার ধন সম্পদ আছে, সে যেন ঐ সম্পদকে ব্যবসা-বাণিজ্যে খাটায়। এমনভাবে যেন, ফেলে না রাখে যে, যাকাতই ওই সম্পদকে ক্রমান্নয়ে গ্রাস করে ফেলে।”
কাজেই এতিমের অভিবাবকদেরকে তাদের অধীনস্ত এতিমের সম্পদ অবশ্যই উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে তা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না করলে এতিমের সম্পদ একদিন ধীরে ধীরে যাকাত দিতে দিতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। ফলে অভিভাবকগণ আমানত যথাযথ সংরক্ষণ না করার জন্য গুনাহগার হবেন। যেখানে এতিমের সম্পদ দ্বারা কারবার করতে গেলে আত্মসাৎ হবার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও তা ব্যবসা-বাণিজ্যে খাটাবার জন্য এ আদেশ দেয়া হয়েছে; সেখানে কেউ নিজের সম্পদ ব্যবসা-বাণিজ্যে না খাটিয়ে এমনি এমনি ফেলে রাখবে আর ইসলাম তার অনুমতি দিবে এমনটি হতে পারে না। এ কারণেই সম্পদ ব্যবসা-বাণিজ্যে না খাটিয়ে তার প্রবৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে তা সঞ্চয় করে রাখা প্রসঙ্গে এক হাদিসের প্রবাদ বাক্যে বলা হয়েছে, সম্পদ সঞ্চয় করে রাখা মানে জাহান্নামের অংশ সঞ্চয় করে রাখা।কাজেই সম্পদকে অনুৎপাদনশীল খাতে ফেলে রাখা মুসলমানের কাছে ইসলাম কখনও কামনা করে না। ইসলাম চায় মুসলমান তার সম্পদ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে, নিজে লাভবান হোক অন্যকে লাভবান করুক। তবে সকলের পক্ষে অর্থ সম্পদ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা, কর্ম সৃজন প্রকল্পে লগ্নি করা, সম্ভবপর হয় না। এ কারণেই প্রয়োজন এমন সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যারা অলস অর্থ সংগ্রহ করে কর্ম সৃজন প্রকল্পে ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। আর এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো ব্যাংক। ব্যাংকই পারে হাজারও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থ সংগ্রহ করে বিরাট আকারের পুঁজিতে পরিণত করে তাকে আর্থ সামাজিক উন্নয়নের কাজে লাগাতে। কর্ম সৃজনশীল প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে।
তদুপরি আধুনিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, আমদানি রপ্তানি করা, বৈদেশিক মুদ্রার আদান প্রদান করা, বর্তমান যুগে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বিশেষত আমদানি রপ্তানিসহ বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য আজকাল ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া ভাবাই যায় না। বর্তমানে চাকুরি, লেখাপড়া, ভ্রমণ ইত্যদির উদ্দেশ্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত বেড়ে গেছে। এসব যাতায়াতে প্রয়োজন অর্থের। আর অর্থ ব্যাংক ব্যবস্থা ছাড়া এক দেশ হতে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা পুরোটাই প্রায় সুদী কারবারে নিমজ্জিত। এসব ব্যাংকের সাথে লেনদেন করলেই কোনো না কোনোভাবে সুদী কারবারে জড়িয়ে পড়তে হয়। কারণ সুদ খাওয়া যেমন অপরাধ; তেমনি সুদ দেওয়া, সুদী কারবারের সাক্ষী হওয়া, তার লেখক হওয়া, সুদী কারবারের যেকোনোভাবে সহযোগী হওয়াও সমান অপরাধ। আগেই বলা হয়েছে সুদ ইসলামের দৃষ্টিতে একটি জঘণ্য অপরাধ। যারা সুদী লেনদেন করে, সুদী লেনদেন পরিহার করে না তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ওহে, যারা ইমান এনেছ, আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদবাবদ যা পাওনা আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক। যদি তোমরা তা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে রাখো।” (সুরা বাকারা)
আলোচ্য আয়াতে প্রথমে মুমিনদেরকে পূর্ব থেকে করে আসা সুদী লেনদেন পরিহার করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, তারপর বলা হয়েছে, তোমরা মুমিন হলে অবশ্যই তা ছেড়ে দিবে, এটাই ঈমানের দাবি। অতঃপর সুদী কারবার পরিহার না করলে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ হতে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
অতএব ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা মুসলমানদের উপর ওয়াজিব। মুসলিম উম্মাহ্ এ কাজ না করলে সকলকেই গুনাহগার হতে হবে। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর কাউকে না কাউকে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে এ উম্মাহকে দায় মুক্ত করতে হবে তাহলেই তারা সুদের মতো এক মারাত্মক গুনাহের ছোবল থেকে রক্ষা পাবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের লানত থেকে বাঁচতে পারবে। মুসলিম সমাজকে নানা আপদ, বিপদ, অনৈতিকতা ও অপরাধ থেকে বাঁচাতে পারবে।