দি ব্যাংকার
প্রকাশ: ১৪:৫৬, ১ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৭:৩২, ১ মে ২০২৫
ব্যাংকার হতে চাইলে
নিজস্ব প্রতিবেদক
ইন্ডেপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে ফিনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করার আগেই মুজাহিদ আলিফ একটি বেসরকারি ব্যাংকে ইন্টার্নশিপে যোগদান করেন। লক্ষ্য, পেশাদার ব্যাংকার হওয়ার আগে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়া। মুজাহিদ আলিফের মতো তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ব্যাংকার হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। নিরাপদ কর্মসংস্থান এবং সেবামূলক করপোরেট পরিবেশ থাকায় ব্যাংকিং খাত সবার জন্যই আকর্ষণীয়। কিন্তু কীভাবে হবেন ব্যাংকার? এক্ষেত্রে এক কথার কোনো জবাব নেই। তবে ব্যাংকার হতে হলে দেশে-বিদেশে ব্যাংকিং ও সমসাময়িক বিষয় সম্পর্কে জানাশোনার প্রস্তুতি এবং সময়ানুবর্তী আচরণ গড়ার দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হবে। এখানে বলতে হবে, ব্যাংকিং অর্থনীতিতে কৌশলী প্রস্তুতি ও ধারাবাহিক পড়াশোনার মাধ্যমে চাকরির বাজারে নিজেকে প্রমাণ করা সহজ। বলে রাখা ভালো, সফলতার কোন শর্টকাট রেসিপি নেই। পেশা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে দরকার কঠোর পরিশ্রম, আগ্রহ আর শেখার প্রবল ইচ্ছা।
এ বিষয়ে এনআরবি ব্যাংকের বর্তমান পরিচালক, প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও বাফেদার টেকনিক্যাল কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মতিউর রহমান জানান, ‘গোটা বিশ্বের অর্থনীতি এখন ইন্টিগ্রেটেড। ফলে ব্যাংকিং খাতে যারা যুক্ত হতে চান তাদের নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি জানার পরিধি বাড়াতে হবে। শিক্ষাজীবন থেকেই তারা এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দক্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হবেন এবং বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যুক্ত হবেন।’
সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো বছরজুড়েই নিয়োগ দিয়ে থাকে। দ্রুত সময়ে পদোন্নতি, ভালো বেতন এবং সামাজিক সম্মানের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে বিধায় এ খাতেই চাকরিপ্রত্যাশীদের সংযুক্ত হওয়ার ইচ্ছে বেশি থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের অধ্যাপক ড. নীলাঞ্জন কুমার সাহা জানান, ‘ব্যাংক সেবা প্রদানের পাশাপাশি সর্বোচ্চ করপোরেট পরিবেশ নিশ্চিত করে। ব্যাংকে প্রতিটি কর্মকর্তাকেই পেশাদারত্ব নিশ্চিত করতে হয়। সে জন্য দক্ষতাবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্যাংকে একজন কর্মীকে সারাদিনের নিখুঁত হিসেব শেষ করতে হয়। যারা বিবিএ করেন তারা এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকেন। কারণ তারা মূলত চার বছর এরই প্রস্তুতি পেয়ে থাকেন। তবে অনেকে নানাভাবে ব্যাংকার হওয়ার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তরুণদের কোন কোন ক্ষেত্রে স্কিল বাড়ানো যায় তা সম্পর্কে সচেতন হওয়া তাই গুরুত্বপূর্ণ।’
ব্যাংকার হতে চাইলে
যেকোনো বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেই ব্যাংকে যুক্ত হওয়া যায়। তবে বর্তমানে অনেক ব্যাংক এমবিএ ও বিবিএ প্রার্থীদের গুরুত্ব দেয় বেশি। এ বিষয়ে শেখ মতিউর রহমান জানান, ‘ব্যাংকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে পারেন। তবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা বিবিএ করেন তারা ক্রেডিট ও রিস্ক ম্যানেজমেন্ট এবং ট্রাজেডি ম্যানেজমেন্টে ভালো করছেন। যেহেতু তারা অ্যাকাডেমিক্যালি এ চর্চায় থাকেন তাই তাদের ভালো করার সুযোগ থাকে বেশি আর এ জন্যই অনেক ব্যাংক নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়।’
তবে যেকোনো বিষয়ে স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণী থাকলেই ব্যাংকে আবেদন করা যায়। কিছু কিছু ব্যাংক নির্দিষ্ট পদে অনেক ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে আবার অনেক ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু পদে বিবিএ, এমবিএ ও অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়। ব্যাংকগুলোর পূর্বতন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোর দিকে চোখ বুলালেই কোন পদে কী কী যোগ্যতা লাগে তা জেনে নেওয়া যায়।
চোখ বুলাতে হবে সংবাদমাধ্যমে
ব্যাংকে নিয়োগের বিজ্ঞাপন বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যায়। ছাত্রজীবন থেকেই যারা ব্যাংকিং পেশার সাথে সংযুক্ত হতে চান তাদের নিয়মিত ব্যাংকিং ও অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদ জানতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকারকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যাংক পেশার সঙ্গে জড়িত হতে চাইলে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। উন্নত বিশ্বে শুধু ব্যাংক বিষয়ক বিশেষায়িত ম্যাগাজিন ও নিউজ পোর্টাল রয়েছে যেখানে ব্যাংক প্রশিক্ষণ, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, সমসাময়িক সংবাদ, দক্ষতাবৃদ্ধির নানা তথ্য থাকে। দেশে এ সংক্রান্ত পোর্টালের অভাব থাকায় অনেকে চাইলেও তথ্য পান না। যারা ব্যাংকিং পেশায় যুক্ত হতে চান তাদের অবশ্যই তথ্য সংগ্রহের বাতিক গড়ে তুলতে হবে। ব্যাংকিং পেশায় তথ্য সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ। কাজটি কঠিন এবং এক্ষেত্রে দিকনির্দেশনার তুলনায় নিজের আগ্রহ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
এ বিষয়ে মুজাহিদ আলিফ জানান, ‘বিবিএর শিক্ষার্থী হওয়ায় আমাদের নিয়মিত এ খাত সংশ্লিষ্ট নিউজ দেখার তাগাদা শিক্ষকরাই দিতেন। বিশেষত আমাদের পাঠ্যক্রম এমন থাকত যে অনেক সময় প্র্যাক্টিকেলের ডাটার জন্য এসব সংবাদ থেকেই তথ্য সংগ্রহ করতে হতো।’
দেশে ব্যাংকভেদে প্রশ্নের ধরন কিছুটা আলাদা হলেও মূল কাঠামো একই থাকে। সাধারণত প্রশ্ন হয় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, দৈনন্দিন বিজ্ঞান ও কম্পিউটার, অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি, পাজলস ও ডাটা সাফিশিয়েন্সি অংশ থেকে। আর লিখিত বা বর্ণনামূলক পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকে গণিত, ইংরেজি ও অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি অংশ থেকে। তাই ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় ভালো করতে হলে প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা পড়তে হবে, সমসাময়িক অর্থনীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। বাংলা ও ইংরেজিতে দক্ষ হওয়া অনেক জরুরি। জি-ম্যাটের প্রশ্ন সমাধান করতে হবে। সময় নিয়ে ব্যাংকে নিয়োগের বিগত বছরের প্রশ্নগুলো সমাধান করতে হবে।
পেশাগত সনদ এগিয়ে রাখবে আপনায়
ব্যাংক চাকরির জন্য পেশাগত সনদ আপনাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে। এজন্য বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি কোর্স আছে। অনলাইন বা অফলাইনে এসব কোর্স থেকে শিখতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়তে চান কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই সময় দেওয়া উচিত।
সময়দক্ষতা ও সমস্যার সমাধানদাতা
ব্যাংকারের চাকরি অনেক সময় গৎবাধা মনে হতে পারে। এ খাতে চাকরি পাওয়ার জন্য গ্রেড বা সিজিপিএ নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পেশার ক্ষেত্রে সফলতার জন্য তার চেয়েও জরুরি হলো আচরণগত দক্ষতা। একজন ব্যাংকার গ্রাহকদের আমানত সংগ্রহ, ঋণপ্রাপ্তি এবং গ্রাহকের অর্থ সরবরাহের কাজ করেন। এক্ষেত্রে গ্রাহকসেবা ও সমস্যা সমাধানের কাজটিও ব্যাংকারকেই করতে হয়। করপোরেট দুনিয়ায় সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে। একটি প্রবাদ রয়েছে, করপোরেটে দ্বিতীয়বার সুযোগের ‘সুযোগ’ নেই। তাই সময় ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। সময়ের কাজ সময়মত শেষ করার চর্চা করতে হবে। বিশেষত যারা ব্যাংক চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন, তাদের সময় ব্যবস্থাপনা সর্ম্পকে ধারণা না থাকলে পরবর্তীতে বিপাকে পড়বেন।
প্রযুক্তিজ্ঞান জরুরি
সময়ের সাথে সাথে ব্যাংক এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে। প্রতিটি ব্যাংক কাগুজে নথিপত্রের বদলে অনলাইন ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা চালু করছে। প্রায় সব ব্যাংক গ্রাহকসেবা দিয়ে থাকে অ্যাপের মাধ্যমে। তাই ব্যাংকারদেরও নিজ ব্যাংকের অ্যাপ পরিচালনা এবং অনলাইন মাধ্যমে গ্রাহকসেবা দেওয়ার কাজটি সম্পর্কে কারিগরি দক্ষতা রাখতে হয়। বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে শেখ মতিউর রহমান জানান, ‘এখন আর ব্যাংক ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে না। সুইফটের মাধ্যমে সহজেই এলসি খোলা যায়। মানুষের আগ্রহ ক্যাশলেস ব্যাংকিংয়ের দিকে। একজন ব্যাংকার মূলত প্রবলেম সলভার। গ্রাহকদের সমস্যা সলভ করার জন্য তার ব্যাংকিং কার্যক্রমকে অবশ্যই অনলাইনভিত্তিক করতে হবে। তাই ডাটা সংরক্ষণ, হিসেব এবং অন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর দক্ষতা বাড়াতে হবে। কম্পিউটার পরিচালনা, মোবাইল অ্যাপের কারিগরি জ্ঞানগুলো জেনে রাখা এখন ব্যাংকারদের জন্য অপরিহার্য।’
অর্থাৎ প্রিয় পেশা ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হতে চাইলে সময়ের সঙ্গে নিজেকে আপডেট করতে হবে। নিজেকে গুছিয়ে দক্ষতা বাড়াতে পারলে নিজের ক্যারিয়ারকে অনেক ওপরে তোলা সম্ভব।