ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

ব্যাংকার থেকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, কে এই মার্ক  কার্নি

দি ব্যাংকার ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬:৪৭, ৫ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৬:৪৮, ৫ মে ২০২৫

ব্যাংকার থেকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী, কে এই মার্ক  কার্নি

ছবি : মার্ক কার্নি

বিগত এক দশক ধরেই বিভিন্ন দেশের সরকারকে অর্থায়ন বিষয়ে পরামর্শ এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে নানাভাবে সহযোগীতা করেছেন তিনি। বলা হচ্ছে, মার্ক কার্নির কথা। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি তুলনামূলক নতুন। তবে জাস্টিন ট্রুডোর পর কানাডার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে এ ব্যাংকারের ওপরই আস্থা রেখেছে দেশটি।  দক্ষিণে দেশটির নিকটতম প্রতিবেশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধে একজন ব্যাংকারই সফল হবেন, অন্তত এমনটিই প্রত্যাশা দেশটির অর্থনীতিবিদদের। দায়িত্ব পাওয়ার পরও তিনি অর্থনীতিকে চাঙা করার ঘোষণা দিয়েছেন।

জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের পর কানাডার লিবারেল পার্টিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মার্ক কার্নিকে নির্বাচিত করা হয়। বিষয়টি অনেকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকেনি। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি কখনও নির্বাচনী হার্ডলে দৌড়াননি, তবে গত নির্বাচনের সময় শোনা গিয়েছিল তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে চাচ্ছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরদিনই এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি অর্থনৈতিক গতিবৃদ্ধির আশ্বাস দেন।

কে এই মার্ক কার্নি

কানাডার উদারপন্থীরা বিগত এক যুগ ধরে অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে কার্নির ওপর নির্ভর করছেন। করোনা মহামারির সময় থেকেই জাস্টিন ট্রুডোর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বপালন করেছেন তিনি। তবে চলতি বছর জানুয়ারিতে জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নেননি। কার্নির প্রধানমন্ত্রী হওয়া কানাডার ইতিহাসে বৈচিত্র্যময় ঘটনাই বটে। তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রায় সবাই ছিলেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ।

কানাডার উত্তর-পশ্চিমে্র ফোর্ট স্মিথে জন্ম নেওয়া কার্নির শৈশব কেটেছে দেশটির আলবার্টা অঞ্চলের এডমন্টনে। তার বাবা ও মা দুজনই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। শৈশবে আইস হকি খেলার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। ছিলেন লরিয়ার হেইটসের গোলকিপার। উচ্চমাধ্যমিক শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হারভার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষা নেন। স্নাতক শেষ করে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট সম্পন্ন করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কর্মজীবন শুরু করেন ব্যাংকার হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডম্যান স্যাকসে প্রায় ১৩ বছর ব্যাংকারের দায়িত্বপালন করেন কার্নি। কর্মসূত্রে এ সময় লন্ডন, টোকিও, নিউইয়র্কের বিভিন্ন ফার্মে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ২০০৩ সালে তিনি ব্যাংক অব কানাডায় যোগদান করেন। ২০০৮ সালে তিনি কানাডার কেন্দ্রিয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পান। কার্নি যে সময় কানাডার কেন্দ্রিয় ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হন, তখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা তীব্র আকার ধারণ করেছে। নিজের নির্বাচনী প্রচারণার সময় ব্যাংকার হিসেবে ওই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রচার করেন। সেখানে তিনি জানান, ওই সময় কানাডায় কর্মসংস্থান তৈরি এবং অর্থনীতির সংকট দূর করার জন্য তাকে একাধিক  সাহসী উদ্যোগ নিতে হয়।

দায়িত্ব পাওয়ার পর পাঁচ বছরে কানাডার আর্থিক সংকট দূর করার কাজে তিনি জরুরি ঋণ সুবিধা চালু করেন। এমনকি সংকটাপন্ন অবস্থায়ও তিনি সুদহার যথাসম্ভব কম রাখতে সক্ষম হন।

 

যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রিয় ব্যাংকে কার্নি

কানাডার কেন্দ্রিয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নরের দায়িত্ব পান। ব্রিটেনের বাইরে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যাকে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রিয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রিয় ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার সময় সেখানেও আর্থিক সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল। পরবরর্তী বছরগুলোতে তা তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় মুদ্রা ছাপানোর খরচ কমাতে তিনি প্লাস্টিকের ব্যাংকনোটের প্রচলন করেন। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ানোর লক্ষে তিনি ‘ফরওয়ার্ড গাইডেন্স’ নামে গ্রাহকসেবা চালু করেন। এ সেবায় তিনি ব্যাংকারদের সঙ্গে গ্রাহকের যোগাযোগের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনেন। মূলত এ সেবায় একজন বিনিয়োগকারী বিভিন্ন অবস্থায় সুদহার কেমন হতে পারে এ বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা ব্যাংক থেকেই পেত। ফলে অনেক বিনিয়োগকারী লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে বিনিয়োগ করতে পারছিলেন। এভাবে তিনি ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। 

অন্যদিকে ব্রিটেনে গণভোটের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগ করে। এ গণভোটটি ব্রেক্সিট নামে পরিচিত। ব্রেক্সিটের আগে কার্নি সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, ব্রেক্সিট সফল হলে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তার সতর্কবার্তা আজ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রিয় ব্যাংকের দায়িত্ব পালনকালে তাকে জাতিসংঘের ক্লাইম্যাট অ্যাকশন অ্যান্ড ফিনান্সের বিশেষ দূত নিয়োগ দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। তখন থেকেই তিনি বিনিয়োগ খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগের বিষয়টিকে জনপ্রিয় করার কাজ শুরু করেন। ২০২০ সালে তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন।

জাতিসংঘকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর আমাকে দেশে-বিদেশের বীমা খাত তদারকি করতে হয়। আমি লক্ষ করি, গোটা বিশ্বে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বিগত সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। গত শতকের তুলনায় একবিংশ শতাব্দিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্তত পাঁচগুণ বেড়েছে। তখন থেকেই আর্থিক খাতে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব নিয়ে আমি কাজ করতে শুরু করি।” 

এরপর থেকেই মার্ক কার্নি কানাডায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। তিনি সাধারন ভোক্তা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর জ্বালানি কর তুলে নেন। তাদের ওপর স্বল্পমূল্যের ভর্তুকি আরোপ করা হয়। এসব কর আদায় করতে শুরু করেন বড় করপোরেশনের কাছ থেকে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কর বাড়ায় তারা তাদের উৎপাদনব্যবস্থা জলবায়ু উপযোগী করে তুলতে বাধ্য হয়। এ উদ্যোগ তখন নানা মহলে প্রশংসা অর্জন করে।

ব্যাংকার থেকে যোগ্য প্রধানমন্ত্রী

কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মার্ক কার্নিই সবচেয়ে যোগ্য বলে অভিমত দেশটির নানা মহলের। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে বৈশ্বিক ব্যাংক ব্যবস্থা বিষয়ে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যাপক কাজে লাগবে বলেই অভিমত অনেকের। নিজের নিরর্বাচনী প্রচারে তিনি এক সম্মেলনে জানান, “কানাডার বর্তমান সংকটাপন্ন অবস্থায় ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞ কাউকে প্রয়োজন। এ সময় রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে।”

 

তথ্যসূত্র :

  • সিএনএন
  • ব্যাংক অব কানাডা ওয়েবসাইট
  • লা মন্টে

আরও পড়ুন