দি ব্যাংকার ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭:১৭, ৭ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৭:২৯, ৭ মে ২০২৫
কোরবানি শব্দের আভিধানিক অর্থ উৎসর্গ করা। আরবি শব্দ ‘কুরব’ থেকে এ শব্দের উৎপত্তি। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নৈকট্যলাভের আশায় কোরবানি করা হয়। প্রতি বছর ঈদুল আজহা দেশের মানুষকে কাছাকাছি আনে এ ধর্মীয় উৎসব। সমাজে ভ্রাতৃত্ব, সংঘবদ্ধতা ও সামাজিক সৌহার্দ্য বাড়ায় এ উৎসব। কোরবানির উদ্দেশ্য সমাজের প্রতিটি মানুষের যোগাযোগ আরও দৃঢ় করা। তাই বারবার কোরবানির মাংস সুষম বণ্টনের বিষয়টিকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কোরবানির সামাজিকায়ন
কোরবানির প্রথম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় আদম (আ)-এর দুই পুত্রের ঘটনা থেকে (সূরা মায়েদা : ২৭)। আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালনে ইব্রাহিম (আ) তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন, যে ঘটনাটি স্রষ্টার প্রতি সমর্পণের অতুলনীয় উদাহরণ। যা নিজের সবচেয়ে প্রিয়, তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ত্যাগের প্রতীক কোরবানি। মদিনায় হিজরতের পর আল্লাহর নামে করা কোরবানির নির্দেশকে নবীজী (স) উৎসবের মর্যাদা দেন ‘ঈদুল আজহা’ নামে।
নবীর জীবন থেকে আমরা জানতে পারি, হুদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে ৭০টি উটকে সুসজ্জিত করা হয়েছিল কোরবানির জন্যে। এ সন্ধি স্বাক্ষরের পর হুদায়বিয়ার প্রান্তরে নবীজী (স) পশু কোরবানি করেন। হিজরতের সাত বছর পর দুই হাজারের বেশি সাহাবীকে নিয়ে নবীজী (স) মক্কায় ওমরাহ করেন এবং ৬০টি উট কোরবানি দেয়া হয়। কোরবানির মাধ্যমে ব্যক্তি শুধু ইবাদত করেন না। তিনি প্রতিবেশি ও আত্নীয়স্বজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়ান। এ জন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
কোরবানি বিষয়ে ইসলাম যা বলে
পবিত্র কোরআনে কোরবানিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরবানির গুরুত্ব উপস্থাপন করে যে নির্দেশনা এসেছে :
হাদিসেও এসেছে কোরবানির প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস :
কোরবানি করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।
–আবু হুরায়রা (রা); ইবনে মাজাহ, আহমদ
রসুলুল্লাহ (স) মদীনায় ১০ বছর ছিলেন। প্রতি বছরই তিনি কোরবানি করেছেন।
–আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা); তিরমিজী, আহমদ
কোরবানি বাড়ায় সামাজিক সুস্থতা
২০২২ সালে আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতাকে ‘গ্রোয়িং পাবলিক হেলথ ইস্যু’বলে চিহ্নিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল ড. বিবেক মূর্তিসহ বিশ্বের প্রথমসারির চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মনোবিদরা নিঃসঙ্গতাকে অভিহিত করছেন মহামারি নামে। তাদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ বাড়ালেই এ মহামারির কবল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
ঈদুল আজহা সামাজিক যোগাযোগের পথ সুলভ করে। ঈদে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি সৌহার্দ্য বিনিময়ের অংশ হিসেবে বাড়ি বাড়ি মাংস পৌছে দেওয়ার মাধ্যমে মানুষ আত্নকেন্দ্রিকতা ও একাকীত্ব থেকে বেরুতে পারে। পারস্পরিক শুভকামনার মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে ইতিবাচকতা।
অভাবী ও বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান
ইসলামের মূল সুর ফুটে ওঠে এই হাদীসটির মধ্য দিয়ে। এটি আমাদের সচেতন করে দেয় যে, একাকী নিভৃতে শুধু ইবাদতে মশগুল থাকলেই বিশ্বাসীর মানদণ্ডে উতরে যাওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বাসীর মর্যাদা পেতে হলে চারপাশে তাকাতে হবে, জানতে হবে আমার নিকটবর্তী পরিবারগুলো ক্ষুধার্ত কিনা, তারা কষ্টে আছে কিনা।
ঈদুল আজহার কর্মতৎপরতায় তাই এ আহ্বানের প্রতিফলন মেলে। সূরা হজ-এর ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জবাই করা পশু থেকে তোমরা খাও এবং অভাবী দরিদ্রদের খাওয়াও।’ কোরবানি উৎসবে প্রতিবেশিদের খোঁজ নেওয়ার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। যে ধর্মেরই হোক না কেন, এ সময় সবাইকে সমান ভেবে সামাজিক মেলবন্ধন বাড়ানোর সুযোগ পাওয়া যায়।
সঙ্ঘবদ্ধতা ও দলগত কাজের গুরুত্ব শেখা যায়
কোরবানির ঈদ এমন এক ধর্মীয় উৎসব, যা একাকী উদযাপন করা অসম্ভব। কোরবানির পশু কেনা থেকে শুরু করে মাংস কাটা, বিতরণ এমনকি বর্জ্য পরিষ্কার—প্রতিটি ধাপেই প্রয়োজন দলবদ্ধ কাজ। উৎসবের এই আনন্দের মাঝে আমরা শিখি সঙ্ঘবদ্ধতা ও দলগত কাজের গুরুত্ব। বাড়ির সবাই কোনো না কোনো কাজে হাত লাগায়। বৃহত্তর পরিবারের সদস্যরা, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন এমনকি এলাকার স্বল্প পরিচিত মানুষেরাও এসময় একে অপরকে সহযোগিতা করে। কোরবানির এ আবহ যেন নীরবে বলে যায়—যদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এভাবে মিলেমিশে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে আমরা কাজ করি, আমাদের প্রত্যেকের অর্জন আরো বেশি হবে।
ধর্ম লোক-দেখানোর অনুষঙ্গ নয়, লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি
লোক-দেখানোর জন্যে বা বাহবা পাওয়ার জন্যে ধর্ম নয়; বরং ধর্মের নির্দেশ পালন করতে হবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে। কারণ তাঁর কাছে আমাদের অন্তর ব্যতীত আর কিছুই পৌঁছায় না। কোরবানির দৃষ্টান্ত দিয়ে সূরা হজ-এর ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা।’
অথচ প্রতিটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মতো কোরবানি নিয়েও এখন পণ্যদাসত্ব ও বাণিজ্যিকীকরণের জোয়ার। এ থেকে মুক্ত থাকতে ব্যক্তির একার প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। চাই সৎসঙ্ঘে একাত্মতা। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষদের সাথে একাত্ম না থাকলে কোনো ভালো কাজই বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব নয়।