মোঃ আঃ রহিম
প্রকাশ: ১৮:২৪, ৮ জুন ২০২৫ | আপডেট: ২০:১৮, ৮ জুন ২০২৫
জীবনে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে লাগে অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও বিনয়। তার জাজ্বাল্য প্রমাণ এই গল্পের ইয়াছিন। চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে সে তার লক্ষ্যে ছিল অটুট। কোনো বাধাই তাকে দমাতে পারেনি। শিক্ষার পেলায় ভর করে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ছিন্ন করে, দারিদ্র্যের অভিশাপ ও কষাঘাত থেকে বেরিয়ে সমৃদ্ধির সোপান তৈরি করে ইয়াছিন। শুধু নিজের পরিবার নয় আলো ছড়ায় গোটা সমাজে।
এক
ভাঙ্গা ছনের ঘর। বর্ষাকালে টপটপ করে পানি পড়ে। ছয় পুত্রসন্তান, মা ও স্ত্রীসহ ৯ সদস্যের পরিবার ইয়াছিনের। ১৯৪৩ সালে (বাংলা ১৩৫০) দুর্ভিক্ষের সময় ইয়াছিন যখন দুই বছর বয়সী, তখন তার বাবা মারা যান। তাই বাবার মুখটিও মনে নেই তার। বাবা বলে কাউকে ডাকতে পারেনি। গ্রামের এক মৌলভী সাহেব তার নাম রাখেন মোঃ ইয়াছিন। বাবার মৃত্যুর পরে চার ভাইবোন ও মা নিয়ে ৫ সদস্যের পরিবার। বড় ভাই সব্দু মিয়ার বয়স তখন ৮ বছর। মায়ের সাথে মিলেমিশে নানাবাড়ির কিছুটা সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ছোট দুই বোন ও একমাত্র ছোট ভাই ইয়াছিনকে মানুষ করে সব্দু মিয়া। দুই বোনকে পার্শ্ববর্তী মেদুলিয়া ও খাসেরচর গ্রামে বিয়ে দিয়ে সংসারী করেন।
ইতোমধ্যে ইয়াছিন বড় হয়েছে। বড় ভাই আদর করে ইয়াছিনকে মাদবর বলে ডাকে। দুই ভাই মিলে সংসার চালায়। এক সময় সব্দু মিয়া বিয়ে করে। ঘরে আসে এক কন্যা সন্তান। কন্যার দেড় বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে মাত্র ২৮ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায় সব্দু মিয়া। সব্দু মিয়ার স্ত্রীও পরের বছর মারা যায়। অল্প বয়সে স্বামী হারা আহেরজান পুত্র শোকে পাথর। ইয়াছিনের বয়স তখন ২২ বছর। একই গ্রামের মৌলভী আহ্মাদ উল্লাহ্ মোল্লাহ্ সাহেবের পিতৃহারা ভাগিনীর সাথে পুত্র ইয়াছিনের বিয়ে দিয়ে ঘরে থিতু হয় মা আহেরজান। পিতৃসম বড় ভাই সব্দু মিয়ার কন্যাকে নিজ বাড়িতে রেখে বিয়ে অবধি লালন পালন করে এবং ১৯৭৮ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিয়ে দিয়ে পিতার দায়িত্ব পালন করে ইয়াছিন। কন্যা সহিতন নেছা পিতৃব্য ইয়াছিনকে কাকু এবং তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে মা বলে ডাকে। দাদী এবং চাচা-চাচীর ঘরে বেড়ে ওঠে যথাসময়ে নিজের ঘর বাঁধে সহিতন। সহিতনের বাবা মানুষ করেছে দু’বছরের অনুজ ইয়াছিনকে। আর ইয়াছিন মানুষ করেছে পিতৃ-মাতৃহারা দেড় বছরের ভাতিজি সহিতনকে।
আসলে ইয়াছিনদের পরিবার দায়িত্ব পালন করা পরিবার। এ ধারা সৃষ্টি করেছে সব্দু মিয়া, ইয়াছিন তা লালন করেছে এবং তার পুত্রদের মধ্যে এ ধারা প্রবাহিত করেছে। ইয়াছিনের নিকট সহিতন শুধু ভাতিজি নয় বরং তার পিতৃরূপী বড় ভাই সব্দু মিয়ার প্রতিচ্ছবি। সহিতনের মাঝে সে প্রতিনিয়ত খুঁজে পেয়েছে বড় ভাই সব্দু মিয়াকে। এখনো ইয়াছিন গভীর রাতে হৃদয়বিদারক গান গেয়ে তার ভাইয়ের জন্য কাঁদে।
দুই
ইয়াছিন পিতা হয়েছে দেশ স্বাধীনের পূর্বে ১৯৬৬ সালে। প্রথম দুই কন্যা বিয়োগের পর এখন ছয় পুত্রসন্তান তার। পিতার এক দেড় বিঘা জমির সামান্য আয়ে মা, স্ত্রী ও সন্তানদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার দেয়া অতীব কঠিন জীবন তার। ইয়াছিন তার শিশুকাল থেকেই বেছে নেয় শরীরের ঘাম ঝরিয়ে দেহনিঃসৃত শক্তি বিক্রি করে আয় রোজগারের পথ। বিয়ের পর সাভার হাট থেকে দেড়মণ ধান কিনে, পায়ে হেঁটে ৭ কি.মি. পথ মাথায় বয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। স্ত্রী রাবেয়া সে ধান সেদ্ধ করে রোদে শুকায় আর রাতভর দু’জনে মিলে ঢেঁকিছাটা করে ৪০ সের চাল তৈরী করে। দেড়মণ ধান ঢেঁকিছাটা করে ৩ সের চাল লাভে থাকে। এভাবে দিনের বেলায় ইয়াছিনের রাস্তার ধারে মাটি কাটা আর রাতের বেলায় স্ত্রীর সাথে ঢেঁকিছাটা চালের ব্যবসায় কিছুটা স্বাবলম্বী হন তারা। দেড়মণ ধান থেকে একমণ চাল তৈরীর ব্যবসাকে এক পৈরছা বলে। তারা ক্রমাগত তিনটি পৈরছা চালায়। এক পৈরছার ধান ভেজানো থাকে, এক পৈরছার ধান সেদ্ধ করে শুকানো হয়। অপর পৈরছার ধান থেকে চাল তৈরী করে বিক্রি করে। এভাবে প্রতিনিয়ত তিন পৈরছা চালু রেখে কঠোর পরিশ্রমে আয় বৃদ্ধি চলতো দু’জনের। ১৯৬৪ সালে শুরু হয় তাদের দাম্পত্য জীবন, শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। এভাবে হাড়ভাঙ্গা কঠোর পরিশ্রম করে কিছু জমিজমাও ক্রয় করে ইয়াছিন যা পরবর্তীতে সন্তানের ভরণ পোষণ ও লেখাপড়ার প্রয়োজনে বিক্রি করে দেয়। সর্বশেষ ভিটে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
প্রথমে দুই কন্যাসন্তান বিয়োগের পর একে একে রাবেয়ার ঘরে আসে ৬ পুত্র সন্তান। মামা-শ্বশুর আহ্মাদ উল্লাহ্ মোল্লাহ্ যিনি স্বনামধন্য ইংরেজি শিক্ষক ও জয়মন্টপ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাকে অনুসরণ করে ইয়াছিন। মামা-শ্বশুরের সন্তানদের লেখাপড়ার সৌন্দর্য্য দেখে চিরায়ত কৃষিজীবন ব্যবস্থার পরিবর্তে নিজ সন্তানদের স্কুলে পাঠায় ইয়াছিন। ইয়াছিন নিজের শরীরের শক্তি বিক্রি করে অতি কষ্টে আয় করে আর গভীরভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয় তার সন্তান যেন তার মতো কষ্ট না করে। তার নিজের জীবনে যে কষ্ট হয়েছে সন্তানের জীবনে যেন সে কষ্ট না আসে। ইয়াছিন পথ পেয়ে যায়, আদর্শ পেয়ে যায়। মামা-শ্বশুর ও তার কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শ্যালক-শ্যালিকার সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে তোলে। তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন এই মামাতো ভাই-বোনদেরকে তাদের ছোট বেলায় দেখভাল করেছে। তার স্ত্রী রাবেয়াও এতীম। রাবেয়া মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতা হারিয়ে পার্শ্ববর্তী ভূমিদক্ষিণ গ্রামের বিশ্বাস বাড়ির পিতৃনিবাস হতে লা শরীক হয়ে এবং আশ্রয় হারিয়ে, বেঁচে
থাকার ও বেড়ে ওঠার আশ্রয় পেয়েছিল তার এই উচ্চ শিক্ষিত মামা বিএ, বিএড পাশ করা স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক আহ্মাদ উল্লাহ্ মোল্লাহ্ সাহেবের বাড়িতে। রাবেয়ার হাতেই বেড়ে উঠেছে তার ৬ মামাতো ভাইবোন, যারা পরবর্তীতে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে।
পিতৃহারা রাবেয়া খাতুন নামক যে ফুপাতো বোনের কোলে-পিঠে চেপে এবং তার আদর-স্নেহে বেড়ে উঠেছে, সেই বোনের স্বামী মোঃ ইয়াছিনকে তারা যথাযোগ্য মর্যাদায় দুলাভাই হিসেবে গ্রহণ করেছে। মোঃ ইয়াছিন নিজে চিন্তা-চেতনা ও চারিত্রিক গুণাবলীতে এক উন্নত মানুষ। প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়া নেই, অথচ স্বশিক্ষায় উন্নত শির। এক বিচক্ষণ মানুষ। গ্রামের মক্তব থেকে আরবী এবং পাশের বাড়ির অনুজ চাচাতো ভাই মো: আলাউদ্দিনের কাছ থেকে রাতে রাতে বাংলা পড়া শিখেছে ইয়াছিন। লিখতে না পারলেও আরবী-বাংলা ভালোভাবে পড়তে পারে সে।
বড় সন্তানকে নিজেই ক্লাস টু পর্যন্ত বাংলা পড়িয়েছে। নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও সন্তানের লেখাপড়া শেখানোর এক অদম্য অনুভূতি সৃষ্টি হয় তার মাঝে। শিক্ষার প্রতি অদম্য স্পৃহার কারণেই এই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শ্যালক শ্যালিকাদের সাথে মোঃ ইয়াছিনের এত সখ্যতা। দিন দিন এই শ্যালক-শ্যালিকা তার নিজ পরিবারের শিক্ষার আদর্শ হয়ে উঠে।
তিন
ইয়াছিন তার সন্তানদের স্কুলে পাঠায়। বড় পুত্র ১৯৭৭ সালে স্কুলে যায়। দরিদ্র পিতার ঘরে খাবারের অভাব হলেও প্রধান শিক্ষক নানা এবং বিচক্ষণ নানীর চৌকষ দেখভাল এবং খালা-মামাদের সংস্পর্শ, আদর-স্নেহ ও অনুপ্রেরণায় তাদেরকে অনুসরণ করে তাদেরই মতো বেড়ে উঠে ইয়াছিনের প্রথম সন্তান মোঃ আঃ রহিম। তৃতীয় খালা মাহফুজা খাতুন এক ক্লাস উপরে পড়ার সুবাদে প্রতি বছর তার নিকট থেকে বই পায় সে। এই খালা একদিকে নতুন ক্লাসের বই দেয়, অন্যদিকে শিক্ষকের ভূমিকায় থেকে ইংরেজি, অংক শেখায়। মেজো খালা শাহিদা খাতুন তার ৫ ক্লাসের বড়। তিনি অতি যত্নে তাকে ইংরেজি গ্রামার শেখায়। ইডেন কলেজ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখনই বাড়িতে ফিরে আসে তখনই অতি যত্ন ও আদর-স্নেহে এবং ধৈর্য্য সহকারে তাকে ইংরেজি অংক শেখায় আর ভবিষ্যতের পথ দেখায়। ১৯৮৫ সালে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর এই মেজে খালা তাকে সায়েন্স নিয়ে লেখাপড়া করতে বারণ করেন। কারণ সে টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়তে পারবে না।
খালার বিচক্ষণ পরামর্শ “আর্টস গ্রুপে পড়, প্রাইভেট ছাড়াই ভালো রেজাল্ট করতে পারবে।” খালার আদর্শ ও স্নেহে মুগ্ধ হয়ে খালার পরামর্শেই পথ চলে সে। আর্টস নিয়ে পড়ে। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে। আর্টস গ্রুপে প্রথম বিভাগ পেয়ে প্রথমবারের মতো বোর্ড স্কলারশীপ পায় এবং উপজেলায় প্রথম স্থান অধিকার করে। উচ্চ মাধ্যমিকেও স্কলারশীপসহ প্রথম বিভাগ পায়। এই শাহিদা খাতুন খালার পাশাপাশি সাভার কলেজের স্বনামধন্য ও বিচক্ষণ শিক্ষক ড. কালী প্রসন্ন দাস মহোদয়ের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনায় লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। ১৯৯০ সালে প্রথমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় এবং পরবর্তীতে মাইগ্রেট করে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে লেখাপড়া করে। কোন সমস্যা হলেই এই খালার কাছেই ছুটে যায় পরামর্শ পাওয়ার জন্য। খালাও বিচক্ষণতার সাথে পথ দেখায়। মনে হয়, এই খালাও প্রতিক্ষণে প্রতীক্ষায় থাকেন তার পুত্রকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার আশা ও নেশায়। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী এই শাহিদা খাতুন খালাই হয়ে উঠে তার মেন্টর ও মা।
চার
১৯৮৯ সালে এইচএসসি পাশের পর ঢাবির রোকেয়া হলের গেস্ট রুমে বসে এই খালার সাথে সাক্ষাত করে চরম দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারে ছোট ছোট ভাইদের লেখাপড়ার বিষয়ে সঠিক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা পাওয়ার আশায় সে জানায় “খালা বাড়িতে তীব্র অভাব, আব্বার শরীর চলেনা। কোমরে ব্যথা নিয়ে মাটি কাটতে পারেনা। টাকার অভাবে সংসার চালাতে পারছেনা। ছোট দু’ভাই দিনমজুরী করে। আবার স্কুলেও যায়। এ অবস্থায় কী করব?” খালা শাহিদা খাতুন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে পথ দেখিয়ে বলে, “ওদেরকে স্কুলেও যেতে বলিস আর কামলাও দিতে বলিস। কিন্তু কোন অবস্থাতেই ওদের লেখাপড়া বন্ধ করিসনা।” খালা হয়তো তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে দূরে কোথাও আলো দেখতে পেয়েছিল। হয়তো বুঝতে পেরেছিল এই আঃ রহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে এবং আবাসিক হলে উঠে টিউশনি করবে এবং টিউশনির আয় দিয়ে ভাইদেরকে লেখাপড়া করানোর সুযোগ পাবে।
পরিশেষে তাই হয়েছে। রোকেয়া হলের গেষ্ট রুমে বসে খালার দেয়া এ পরামর্শই দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের জন্য শিক্ষাভিত্তিক দারিদ্র্যবিনাশ, শিক্ষাভিত্তিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অভিযাত্রার বীজ বপন হয়েছিল। একেই বলে “ A Stitch in time saves nine.” চিরায়ত বাংলার প্রবাদে আছে, “এক প্লেট ভাত দিয়ে মারে। আর একটা সঠিক পরামর্শ দিয়ে জীবন বাঁচায়।” একজন বিচক্ষণ শাহিদা খালার যথাসময়ে একটা সঠিক পরামর্শে একটি চরম দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের পুরো জীবনধারা ও দৃশ্যপট পাল্টে যায়। দারিদ্র্য পিছু হটে ও প্রস্থান করে। আর দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারবর্গ স্থান করে নেয় সমৃদ্ধির সোপানে।
চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ১৯৮৭ সালে এসএসসি, ১৯৮৯ সালে এইচএসসি পাস করে সে। ১৯৯২ সালের অনার্স ১৯৯৫ সালে এবং ১৯৯৩ সালের মাস্টার্স ১৯৯৭ সালে পাস করে। অনার্সে ৫৮% এবং মাস্টার্সে ৬১% নম্বর পেয়ে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম ১ বছর নিজ গ্রামের মাতৃসম ভাবি কুলসুম ইসলামের ৫৩ বনগ্রাম, ওয়ারী ঢাকার বাসায় আশ্রয় পায়। বিনা পয়সায় এবং আদর-স্নেহে থাকা খাওয়ার সুযোগ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার নিশ্চয়তা পায়। তার বাবা তাকে ১টি টাকাও দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বা থাকা খাওয়ার খরচ চালানোর জন্য। টিউশনি করে জমানো টাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। অন্যের পুরোনো প্যান্ট-শার্ট পরেই অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত ক্লাস করতে হয়েছে।
এই মাতৃসম ভাবির বাসায় অবস্থানকালে দ্বিতীয় মাস, ২৮ জুলাই, ১৯৯০ থেকেই টিউশনী শুরু করে সে। মাতৃসম এই ভাবির বাসায় ১১ মাস থাকার পর কয়েকটি টিউশনির আয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে চলে আসে। শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। বিকাল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রতিদিন চলে দু-তিন বাসায় পড়ানো। প্রতি সপ্তাহে মোট ৫টি টিউশনি করে। এ মহল্লায় ৩ দিন, ঐ মহল্লায় ৩ দিন এভাবে টিউশনি করে মাসে ২/৩ হাজার টাকা আয় করে। নিজের জন্য ৮০০ টাকা রেখে বাকী টাকা বাড়িতে পাঠায়। নিজের লেখাপড়ার সময় টিউশনিতে ব্যয় করে টিউশনির টাকায় নিজের লেখাপড়া চলে এবং বাবার সংসার খরচ চলে। ছোট ভাইদের দিনমজুরি বন্ধ হয় এবং চালু হয় তাদের পূর্ণোদ্যমে লেখাপড়া।
পাঁচ
১৯৮৫ সালে নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পাশের বাড়ির এক কাকা আদর করে জয়মন্টপ বাজার থেকে ২০০ টাকা মূল্যে জাপানী টরে কাপড়ের সুন্দর একটি শার্ট তৈরী করে দিলেন। এ সময় সে একজনের দুটি পুরনো শার্ট সংগ্রহ করে গ্রামের দর্জি জনাব আল্লাদ খলিফা (জনাব আমজাদ হোসেন নান্নু এবং এডভোকেট আফতাব হোসেনের পিতা) এর মাধ্যমে ছোট করে পরিধান করে। ১৯৮৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার সময় নতুন পোশাক কেনার টাকা নেই। পাশের বাড়ির শ্রদ্ধেয়া এক দাদী তাকে অত্যন্ত আদর করতেন। তিনি তাঁর ৫/৬টি মুরগী বিক্রি করে জামা কাপড় কেনার ব্যবস্থা করে দেন। মুরগিগুলো ৩০০ টাকায় বিক্রি করে একটি সাদা কেড্স এবং সাদা রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি তৈরী করে। এ পোশাক পরিধান করে সে এসএসসি পরীক্ষা দেয় এবং পরবর্তীতে সাভার কলেজে ক্লাস করে।
১৯৮৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর মা রাবেয়া খাতুন পার্শ্ববর্তী ভূমদক্ষিণ গ্রামে তার বংশধর বিশ্বাস বাড়ী হতে বেশকিছু বাঁশ সংগ্রহ করেন। এসব বাঁশ ব্যবহার করে বাবা একটি ছনের ঘর তৈরী করলেন। জীবনে এই প্রথম নিজের জন্য রুম পেলো লেখাপড়ার জন্য। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত বাড়িতে কোন টেবিল ছিলনা। ঘরের পাটকাঠির বেড়ার সাথে পুরনো নৌকার একখন্ড তক্তা। কাঠ দু’পাশে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে তার উপর লিখতো সে। এটাই পড়ার টেবিল।
১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় সারাদেশ যখন পানিতে নিমজ্জিত তখন ভূমদক্ষিণ গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুর রহমান সাহেব (এস ডি ই) এবং তাঁর পুত্র প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম সাহেবের মাধ্যমে রোটারী ক্লাব অব ঢাকা ওয়েস্ট জায়গীর গ্রামে খাদ্য ও পোষাক সামগ্রী সহযোগিতার জন্য আসেন। রোটারী ক্লাবের পক্ষ থেকে তাদের পরিবারে ১০ ফুট লম্বা ৭ খন্ড টিন দেয়া হয়। এ টিনের ঘরে বাস করে জনাব ইয়াছিনের স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা লেখাপড়া করার সুযোগ পায়। বন্যা চলাকালীন খাদ্যসামগ্রী বিতরণরত অবস্থায় একজন সিনিয়র রোটারীয়ান বলেন, “শুধু খাদ্য সরবরাহ করলে দেশের মানুষ হাত পাততে শিখবে। তারা কখনও স্বাবলম্বী হবেনা। তাদেরকে শিক্ষা সহায়তা দিতে হবে। এতে দেশের মানুষ স্বাবলম্বী হতে শিখবে, স্বাবলম্বী হবে।”
শিক্ষা সংক্রান্ত রোটারী ক্লাব কর্মকর্তার উক্তিটি এখনও তার কানে ভেসে আসে। মহোদয়ের এ উক্তি থেকে শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করতে শেখে আঃ রহিম। শিক্ষা অর্জন করে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়া যাবে এ অনুভূতি মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে স্থান করে নেয়। উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে রোটারী ক্লাব তাকে এক হাজার টাকার শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে সহযোগিতা করে। বন্যা পরবর্তী সময়ে রোটারী ক্লাবের টিম জানুয়ারী ১৯৮৯ সালে আবার আসেন। তারা গ্রামের মেঠো পথ ও ফসলের মাঠ দিয়ে হেঁটে বেড়ান। এ সময়ে আঃ রহিম তাদের সঙ্গ দেয়। এদের মধ্যে একজন বুয়েটের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি তার লেখাপড়ার খোঁজ খবর নিলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ তুমি কী হতে চাও?”
উত্তরে সে বলে, “আমি ডিসি হতে চাই।”
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি জান কিভাবে ডিসি হতে হয়?”
উত্তরে সে বলে, “জ্বীনা স্যার।”
তখন তিনি আদরের সাথে বুঝিয়ে বলেন, “তোমার আজকের কাজ হচ্ছে ভালোমতো লেখাপড়া করা। তুমি তোমার আজকের কাজ ভালোমত কর। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া কর। সময় নিয়ে লেখাপড়া করে ভালো রেজাল্ট কর। একদিন তুমি তোমার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।”
১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ক্লাস করার মতো জামা কাপড় নেই। শ্রদ্ধেয় ড. কালীপ্রসন্ন দাস স্যারের পরিচিত এবং Religious Youth Service (RYS) নামক যে প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে নিজ গ্রামে জায়গীর প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হতো এর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক (১৯৮৯-১৯৯২) ধানমন্ডি শংকর এলাকায় বসবাসরত জনাব মাসুদ সাহেবের নিকট থেকে ৪/৫ টি প্যান্ট-শার্ট সংগ্রহ করে। এসব প্যান্ট-শার্ট পরিধান করে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত ক্লাস করে। সেকেন্ড ইয়ারে এসে হলে উঠার সময় বিছানায় তোষক কেনার টাকা নেই। শ্রদ্ধেয় ড. কালী প্রসন্ন দাস স্যার ঢাকার নীলক্ষেতের ফারুক বেডিং থেকে ৪০০ টাকা মূল্যে তোষক কিনে দিলেন। এ তোষক বিছিয়ে সে ঘুমায়। টিউশনি করে। নিজে কোনমতে চলার জন্য ৮০০ টাকা রেখে বাকী টাকা বাড়িতে পাঠায় বাবার সংসার চালানোর জন্য। নিজের মশারী কেনার টাকা নেই। ছোট বেলা থেকেই মশার আওয়াজ ও উপদ্রব সহ্য করতে পারে না। হাইস্কুলে পড়া অবস্থায় গ্রীষ্মকালে মশার কামড়ের ভয়ে ঘরের বেড়ার সাথে বাঁশের সাহায্যে কাঁথা ঝুলিয়ে বেড়া ও কাথার ফাঁকে মাথা রেখে মশার অত্যাচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতো। মাথা ব্যতীত সারা শরীর তীব্র গরমের মাঝেও কাঁথা জড়িয়ে রাখতো। গরমে শরীর ভিজে যেত ঘামে তবুও মশার উপদ্রব থেকে তাকে বাঁচতে হবে। হলে উঠার পর মশারী কেনার টাকা নেই। একটি কয়েলের দাম দু’টাকা। মশারীর দাম দু’শো টাকা। হল জীবনেও মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে গরমের মধ্যে কম্বল গায়ে জড়িয়ে ঘুমাতে হয়েছে।
অনেক পরে মশারী কিনেছে টিউশনির টাকায়। জীবনে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে লাগে অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও বিনয়। পাশে আসে এবং পাশে লাগে একজন কাকার আদর, নিজের সম্বল ও শখের মুরগি বিক্রির টাকা দিয়ে জামা কাপড় তৈরী করে দেয়া মায়াবী দাদী। দরিদ্র ঘরের সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে তাকে বাসায় আশ্রয় দিতে হবে এমন একজন মাতৃসম মায়াবী ভাবি। ছাত্র হলে উঠেছে, অবশ্যই তার বিছানার তোষক নেই। দূর থেকে এরূপ গভীর উপলব্ধি দিয়ে পর্যবেক্ষণকারী একজন ড. কালী প্রসন্ন দাস স্যার। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রতি প্রয়োজনে প্রতিক্ষণের পেলা। জীবন গড়ার পেলা। (ধারাবাহিক)
লেখক: উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড।
এএ
মোঃ আঃ রহিম