ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

যে ঘটনায় মিসাইলম্যান হলেন এপিজে আবদুল কালাম

দি ব্যাংকার ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭:২০, ৪ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৮:১৩, ৪ মে ২০২৫

যে ঘটনায় মিসাইলম্যান হলেন এপিজে আবদুল কালাম

যুগে যুগে কালে কালে শিক্ষকরা নিরবে শুধু মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করেননি। শিক্ষার্থীদের জুগিয়েছেন আরও বড় বিস্তারের স্বপ্ন দেখার রসদ। অনেক সময় তারা শিক্ষার্থীদের মনে এমন দিপশিখা জালিয়েছেন যা তাদের আরও ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ দিয়েছে। যারা দেশ, জাতি ও সমাজকে প্রভাবিত করেছেন তাদের পরিচয়ের সাথে শিক্ষকদের পরিচয়ও দিগ্বিদিক ছড়িয়ে গেছে। তাদের পরিচয় বড় হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষকের ভূমিকাও মানুষের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

 

উদাহরণ ১ : এরিস্টটলের তিন ছাত্রই স্বনামে খ্যাতিমান হয়েছেন

এরিস্টটল ছিলেন আলেকজান্ডারের শিক্ষক। মেসিডোনিয়ার এ শাসক আলেকজান্ডার একমাত্র ইউরোপিয়ান যিনি প্রথম ভারতবর্ষ পর্যন্ত আগমন করেন। এই গঙ্গোরিডি গঙ্গার পূর্বপাড় পৌঁছান প্রথম ইউরোপিয়ান এবং তার আগে এত বিশাল সাম্রাজ্যের এত বিশাল বিস্তৃতি আর কেউ করতে পারেন নাই। এক অর্থে তিনি ভাগ্যবান শিক্ষক, এমনটি বলা যায়। তবে এরিস্টটলের আরও দুজন শিক্ষার্থী গ্রিক জ্ঞান ও সভ্যতার উৎকর্ষে অবদান রেখেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন থিওফ্রেস্টাস। এরিস্টটলের মৃত্যুর পর থিওফ্রেস্টাস লাইসিয়ামের দায়িত্ব নেন। এছাড়া গ্রিসে নীতি-নৈতিকতা এবং সংগীত নিয়ে চর্চা করেছেন এরিস্টোজেনাস। তিনিও ছিলেন এরিস্টটলের শিক্ষার্থী। এনারা সবাই স্বনামে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাতে এরিস্টটলের নাম আরও ছড়িয়ে পড়ে।

 

উদাহরণ ২ : রাজগুরুর বাণীই প্রতিফলিত হয়েছিল গৌতমবুদ্ধের জীবনে…

গৌতমবুদ্ধ সিদ্ধার্থ রাজকুমার ছিলেন। তার স্বপ্ন কিন্তু সেই ছোটবেলায় সঞ্চারিত হয়ে যায়। তৎকালীন রাজগুরুকে নামকরণের জন্য পাঠানো হলে তিনি শুধু নাম দেননি। তিনি সঙ্গে একটি বার্তাও দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাজকুমার সন্ন্যাসী হবে। পরবর্তীতে রাজা সিদ্ধার্তের সন্ন্যাসও আটকাতে পারেননি। স্বপ্নটা ওই সময় রাজকুমার বুঝুক আর না বুঝুক তার কানে কিন্তু সে বাণী গিয়েছে, তুমি সন্ন্যাসী হবে!

 

এপিজে আব্দুল কালামের জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা

এপিজে আব্দুল কালাম একাধারে ভালো মানুষ, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী এবং দক্ষ  রাষ্ট্রপতি। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় বিমান, ওড়া এবং উড়তে শেখার আগ্রহ থেকেই বিজ্ঞানী হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। কিন্তু শুধু তার একার ইচ্ছে নয়, তার জীবনেও প্রভাব ছিল শিক্ষকের। 

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরমে সাধারণ এক মুসলিম পরিবারে এপিজে আব্দুল কালামের জন্ম। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আপাত সাধারণ সেই পরিবারে ছিল অসাধারণ জীবনবোধের প্রবাহ। অর্থের দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু পিতার মননের প্রাচুর্য ছোটবেলাতেই তার মনে গেঁথে দিয়েছিল বড় মানুষ হওয়ার, ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। পরিবারের কাছ থেকে নৈতিক শক্তি ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন আবদুল কালাম। এজন্যেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন—দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং সুন্দর মনের মানুষ গড়ে তুলতে পারেন সমাজের তিন জন মানুষ। তারা হলেন বাবা, মা এবং শিক্ষক।

আধুনিক মানুষের মধ্যে নৈতিক শক্তির জাগরণের লক্ষ্যেই তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সবার প্রতি তার আহবান ছিল, তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি ভবনে তিনি প্রবেশ করেছিলেন ব্যক্তিগত কিছু জিনিস ও বইপত্রসহ দুটো সুটকেস নিয়ে। যেদিন রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন, সেদিনও তার সাথে সুটকেস মাত্র দুটোই। দায়িত্বে থাকাকালীন যত উপহার-উপঢৌকন পেয়েছেন, সব রেখে এলেন অবলীলায়। তার বক্তব্য ছিল, এর কিছুই তো ব্যক্তি কালামের নয়। সবই দেয়া হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতির সম্মানে। তাই এসব উপহার রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেই থাকা উচিত।

২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পূর্ণ করার পর তিনি সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন শিশু-কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করার কাজে। মহৎ লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে নিরন্তর স্বপ্ন দেখিয়েছেন নতুন প্রজন্মকে। লিখেছেন উইংস অব ফায়ার, ইগনাইটেড মাইন্ডস, ইনডমিটেবল স্পিরিট, ইউ আর বর্ন টু ব্লোসম, মাই জার্নি, টার্নিং পয়েন্টস-এর মতো বই, যা বিশ্বাস ও আশার একেকটি ফল্গুধারা।

ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট বিজ্ঞানের প্রসারে তার অবদান অতুলনীয়। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন একজন বরেণ্য বিজ্ঞানী, তেমনি ছিলেন কল্যাণচিন্তা ও নৈতিকতায় অনুপ্রাণিত এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সত্যিকারের ধ্যানী, জ্ঞানী ও কর্মী।

 

শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের পাখি নিয়ে আলোচনা থেকেই শুরু

এপিজে আব্দুল কালাম যখন পঞ্চম শ্রেণীতে তখন শিব সুব্রামানিয়া নামে এক শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। একদিন তিনি শ্রেণীতে পাঠদানকালে পাখির ওড়া নিয়ে আলোচনা করছিলেন। ব্ল্যাকবোর্ডে তিনি পাখির ডানা, মাথা ও লেজ আঁকলেন। এঁকে এঁকে দেখালেন কীভাবে ডানাটা ছড়ানো যায়। এক সময় বললেন, পাখি এভাবে ডানা ছড়িয়ে দেয়। তার গতি পরিবর্তনের জন্য কিংবা ওপরে-নিচে নামার জন্য লেজকে ডানে-বায়ে ঘুরিয়ে নেয়।

২৫ মিনিট এ আলোচনা শোনার পর এপিজে আব্দুল কালাম একসময় জানালেন, আমি কথাটা বুঝিনি।

শিব সুব্রামানিয়া আলোচনায় জানায় তারা কীভাবে সারি বেঁধে ওড়ে। পাখির ঝাঁক ১০, ২০, ৩০ ও ৪০টি ফরমেশন অনুসরণ করে। তিনি এক সময় জানান, পাখির সারি এবং ফাইটার প্লেনের ফরমেশন এক। শিক্ষার্থীরা যেন তা বুঝতে পারে সেজন্য তিনি ভালোভাবে ব্যখ্যা করলেন। আলোচনা শেষে নিশ্চিত হতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা বুঝতে পেরেছ পাখি কীভাবে ওড়ে?

এপিজে আব্দুল কালাম আবার বললেন, আমি বুঝতে পারিনি।

শিব সুব্রামানিয়া এবার বাকিদের একই প্রশ্ন করলেন। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জানালেন, তারা বুঝতে পারেনি।

এবার তিনি উড়ন্ত গাঙচিলের উদাহরণ টেনে বোঝালেন কীভাবে পাখি ওড়ে। সেজন্য তিনি তিনি তাদের বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। সন্ধ্যাবেলা আমরা যাব আব্দুল কালামের বাড়ি।” এপিজে আব্দুল কালামের বাবা মসজিদের ইমামতীর পাশাপাশি জেলে হিসেবে কাজ করতেন। তাই তাদের বাড়ি ছিল সমুদ্রের পাশে।

ক্লাসের সবাইকে নিয়ে তারা তিনি সমুদ্রের ধারে গেলেন। সমুদ্রের পাড়ে সবসময় গাঙচিল ঝাঁক বেধে উড়ছে আর নামছে। পাখি কীভাবে ওড়ে তা বোঝালেন। এক সময় প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বিমান দেখেছ? বিমানের ইঞ্জিন আছে। পাখির যে ইঞ্জিন এই ইঞ্জিনকে শক্তি যোগায় কে? তিনি তাদের বোঝালেন, পাখির ইঞ্জিনের শক্তি তার জীবন। পাখি নিজের জীবনের শক্তি দিয়ে ওড়ে। পাখি তার চাওয়াকে শক্তিতে রূপ দিয়ে ওড়ে।

এপিজে আব্দুল কালাম মনোযোগ দিয়ে ১৫ মিনিট তার আলোচনা শুনে অবশেষে বললেন, বুঝেছি। সকালে ২৫ মিনিট এবং সন্ধ্যায় আরও ১৫ মিনিট বোঝালেন। এক সময় তিনি জানান, এই যে পাখি ওড়ে তার ব্যখ্যা আমার মনে এক বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে। আমি পাখির ওড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে শুরু করি। ভাবতে শুরু করি। ওই সন্ধ্যা থেকেই আমার চিন্তায় পাখির ভাবনা ঢুকে গেল।   

 

এই ঘটনাই বদলে দিল ভবিষ্যত…

সেদিনের পর থেকেই ক্লাসের সবাই তাদের ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে। একদিন ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় আব্দুল কালাম শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, ওড়ার বিষয়ে বিস্তারিত জানার উপায় কী? আমি কীভাবে আরও জানতে পারি?”

শিক্ষক তাকে জানালেন, ‘দেখ, ওড়ার জ্ঞান আয়ত্ব করতে হলে প্রথমে অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ হতে হবে। তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হবে। সেখান থেকে ভালো ফল নিয়ে প্রকৌশলী কলেজে ভর্তি হতে হবে। সেখানেই তুমি জানার রসদ পাবে।”

এপিজে আব্দুল কালাম ওড়ার বিজ্ঞান আয়ত্ত করার প্রতিজ্ঞা নিলেন। এ বিষয়ে জানার জন্য তিনি সবকিছু  করবেন জানালেন। শেখার জন্য তিনি সড়কে বিক্রির কাজও করেছেন। রেলের ডাক পদ্ধতি তখন ছিল অন্যরকম। ডাক বহনকারী রেল কোনো স্টেশনে থামে না। স্টেশন পাড়ি দেওয়ার সময় ফেলে দিয়ে যায়। তার বাড়ির কাছের স্টেশনেও পত্রিকা ফেলে দিয়ে যাওয়া হতো। নির্দিষ্ট স্থান থেকে পত্রিকা নিয়ে তিনি ঘরে ঘরে বিলি করতেন। এভাবেই তিনি হকারি করেছেন। আকাশে ওড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্যই তিনি এ কাজ করেছেন। স্বপ্ন পূরণের সব পথই উন্মুক্ত করে রেখেছেন।

 

অবশেষে হলেন মিসাইলম্যান

মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এপিজে আব্দুল কালাম অ্যারোনটিক্যাল সায়েন্স বাছাই করলেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। শুধু একজন প্রকৌশলীই নন, মহাকাশযানের উদ্যোক্তা হিসেবেও পেলেন সফলতা। এ জন্যই তাকে বলা হয় ভারতীয় মিসাইলম্যান। ভারতীয় মিসাইলের জনকের এ সফলতার ঘটনার সূত্রপাত ছোট একটি প্রশ্ন থেকে। “পাখি কীভাবে ওড়ে?”—এ প্রশ্ন থেকে আকাঙ্ক্ষা এবং অবশেষে স্বপ্নপূরণের যাত্রা। আর এ স্বপ্নপূরণের পাটাতনে তুলে দিয়েছেন তার শিক্ষক।

 

প্রতিটি সফল শিক্ষক দুটো কাজ করেন

কোরআন শরীফে সূরা মূলকে বলা আছে, “তারা কি তাদের ওপরের দিকে পাখিগুলোর প্রতি লক্ষ্য করে না, যারা ডানা মেলে ধরে আবার গুটিয়ে নেয় তথা ডানা ঝাপটিয়ে ওড়ে? দয়াময় ছাড়া অন্য কেউই তাদের স্থির রাখেন না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছুর সম্যক দ্রষ্টা।”—(সুরা  মুলক, আয়াত: ১৯)

এই কৌতূহল ও আগ্রহ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটো বিষয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগাতে পারলে শিক্ষক সফল হন। কৌতূহল সৃষ্টির পাশাপাশি তা পূরণের আগ্রহ জাগাতে উদ্যম জাগাতে হয়।  একজন শিক্ষক এ দুটো স্তরকেই বাস্তবে রূপ দিতে পারেন বিধায় তিনি সফল। এ সফলতাই তার শিক্ষাকে মহিমা দেয়। সে পথ খুঁজে পায়। তাই সব সফল শিক্ষকের প্রসঙ্গ উঠে আসে এ দুটো কাজের পর্যালোচনায়।  

 

আরও পড়ুন