নাঈমা সুলতানা
প্রকাশ: ১৮:১০, ১৪ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৯:২৫, ১৪ মে ২০২৫
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার যখন চাঙ্গা তখন বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে আকষর্ণীয় শেয়ার ছিল ব্যাংকের শেয়ার। ২০১০ সালে বাজারে যে উত্থান দেখা গিয়েছিল, তার পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল ব্যাংকগুলোর শেয়ারের উত্থান। তবে ২০১১ সালে শেয়ারবাজারে ধ্বসের সময় ব্যাংকের শেয়ারগুলোও দাম হারাতে থাকে। পরে অন্য খাতের শেয়ার কিছুটা ঘুরে দাাঁড়ালেও ব্যাংকের শেয়ারে তেমনটা হয়নি। বরং দিন দিন দাম হারাতে হারাতে তলানীতে নেমে এসেছে ব্যাংকের শেয়ার।
এমনকি সাতটি ব্যাংকের শেয়ারের দাম পাঁচ টাকার চেয়েও কম। যা দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে আর কখনও দেখা যায়নি, একমাত্র আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া। এবং এই সাতটি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ছয়টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম এক সময় অন্তত তার চেয়ে দশগুণ বেশি ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এক সময়ের এত ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন ব্যাংকের শেয়ার এভাবে দর হারানোর পেছনে মূল কারণ হলো ঋণ কেলেঙ্কারি। ব্যাংক পরিচালকদের যোগসাজশে এসব ব্যাংকের ঋণের বড় অংশই বর্তমানে টক্সিক অ্যাসেটে পরিণত হয়েছে। আর ব্যাংকগুলোতে টক্সিক এসেট এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি থাকায় ভালো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। যে কারণে শেয়ারগুলো দর হারিয়েছে।
ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়া নজরদারিতে থাকার পরও বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো, মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো ব্যাংক বড় অংকের মুনাফা করার ঘোষণা দিয়েছে। ঋণের সুদের হারের উপর বেধে দেওয়া ক্যাপ তুলে নেওয়ার পর ২০২৪ সালে একাধিক ব্যাংকই তাদের মুনাফা প্রথম বারের মতো হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে। তাছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোরও মুনাফা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এই মুনাফা বাড়ার মূল কারণ তাদের ঋণের সুদের আয় বেড়েছে ২০-২৫%, কারণ ৯% সুদের সীমা তুলে নেওয়ার পর ঋণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাছাড়া ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বন্ড ও বিলের উপর বিনিয়োগ থেকে আয় বেড়েছে, যেখানে কিছু মেয়াদের রিটার্ন ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এছাড়া ফি ও চার্জ যেমন এলসি চার্জ, অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ফি, ডকুমেন্টেশন ফি থেকে ব্যাংকগুলোর আয় বেড়েছে ১৮-২২% হারে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে লাভ একটি নতুন আয়ের উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ডলার-টাকার অনিশ্চয়তা কাজে লাগিয়ে বেশিরভাগ ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলারে ১-৫ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত প্রিমিয়াম ধার্য করার অভিযোগ রয়েছে। যেখানে আমদানিকারকরা গত ৩/৪ বছর যাবৎ যেখানে ক্রমাগতভাবে ডলার রেটে লোকসান করছে সেখানে ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা দ্বিগুন করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংকগুলো কী এ মুনাফা লভ্যাংশ হিসেবে দিতে পারবে। এখন পর্যন্ত তার উত্তর হচ্ছে, ব্যাংকগুলোকে লভ্যাংশ দিতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক লভ্যাংশ যেন কম দেয় সে ব্যাপারে তৎপর। এক্ষেত্রে অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যুক্তিও শক্ত। যেহেতু ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়লেও অনেকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। আবার অনেকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি, তাছাড়া অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকটও রয়েছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে সুসংহত করতে শুধু শক্তিশালী ব্যাংকগুলোকেই ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার অনুমতি দিতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো একসময় মানুষের কাছে খূব আকষর্ণীয় ছিল, কারণ সে সময় ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ দিতে পেরেছে। তাছাড়া সে সময় ব্যাংকগুলোর অবস্থাও ভালো ছিল। দিন যত গড়িয়েছে, ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আর খেলাপি ঋণ যতটা বেড়েছে, তার চেয়েও বেশি বেড়েছে অনিশ্চয়তা। যেহেতু অনেক ব্যাংক তাদের প্রকৃত অবস্থা ঠিকভাবে আর্থিক প্রতিবেদনে দেখায়নি, ফলে বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারে না, ব্যাংকের অবস্থা সত্যিকার অর্থে কেমন। ফলে তারা এই শেয়ার কিনতে ভয় পায়।
আবু আহমেদ মনে করেন, সব ব্যাংকের অবস্থা এক রকম নয়। অনেক ব্যাংক খুব ভালো ব্যবসা করছে। কিন্তু সেই তুলনায় তাদের শেয়ারের দাম কম। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, বিনিয়োগকারীদের মাইন্ডসেট এমন যে ব্যাংকের শেয়ারের দাম বাড়ে না। ফলে অনেকে ব্যাংকের শেয়ার কিনতে চান না। যেহেতু ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন বেশি, ফলে তাদের শেয়ারের সংখ্যাও বেশি। এতে করে শেয়ারের দাম সহজে ওঠানামা করে না। এটিও ব্যাংকের শেয়ার থেকে মানুষের আকর্ষণ হারানোর একটি কারণ।
বিশ্লেষকরা মনে করেছেন, ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য ঠিক করতে এই মুহূর্তে ভালো ব্যাংকগুলো ছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ কম দেওয়া যুক্তিযুক্ত। তবে যেহেতু ব্যাংকগুলোর খারাপ অবস্থার জন্য তাদের পরিচালকরাই বেশি দায়ী, তাই তাদেরকে কোন লভ্যাংশ না দিয়ে, বরং সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদেরকে অল্প করে হলেও লভ্যাংশ দেওয়া দরকার।
এতে করে ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডাররা কিছুটা উৎসাহ পাবেন মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নাঈমা সুলতানা