ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়ে এলেও নেই সংস্কারের উদ্যোগ

ব্যাংকার প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২০:৪২, ১৯ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২০:৪৩, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়ে এলেও নেই সংস্কারের উদ্যোগ

গত দেড় দশকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের শাসনামলের অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোর একটি জনতা ব্যাংক পিএলসি। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি এখন খেলাপি। নগদ অর্থের তীব্র সংকটে থাকা এ ব্যাংক কেবল গত বছরই ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি নিট লোকসান গুনেছে।

ঋণ দেয়ার মতো অবস্থা না থাকায় ব্যাংকটির ১৪ হাজারের বেশি কর্মীর এখন তেমন কোনো কাজ নেই। কর্মীদের কেউ কেউ কেবল দৈনন্দিন লেনদেন ও আমানত সংগ্রহে কাজ করলেও তাদের অনেকে প্রায় অলস সময় কাটাচ্ছেন।

২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে লুটপাটে দেউলিয়া হয়ে পড়া বেসিক ব্যাংক গত এক যুগে ৫ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা নিট লোকসান গুনেছে। প্রায় ৭০ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে ধুঁকতে থাকা এ ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন দুই হাজারের বেশি কর্মী। এক যুগের বেশি সময় ধরে এ কর্মীদের বড় অংশের তেমন কোনো কাজ নেই। সময় যত যাচ্ছে বেসিক ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি ও লোকসানের ক্ষত তত গভীর হচ্ছে।

দেশে বর্তমানে সরকারের মালিকানাধীন তফসিলি ব্যাংক রয়েছে ৯টি। এর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) বাণিজিক ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। আর বিশেষায়িত তিন ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। এর বাইরে তফসিল-বহির্ভূত ব্যাংক রয়েছে আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব ব্যাংকে বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিযুক্ত রয়েছেন। বিপুল খেলাপি ঋণের চাপ, মূলধন ও সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতি, তারল্য সংকট, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতাসহ বহুমুখী সংকটের প্রভাবে প্রায় সব ব্যাংকই নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে। ব্যাংকগুলোর অনেক কর্মী এখন প্রায় অলস সময় পার করছেন। কাজের চাপ না থাকায় তাদের মধ্যে দলাদলিও বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকের মূল দায়িত্ব ছিল সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশনের অর্থ পরিশোধ, সঞ্চয়পত্র বিক্রি, সরকারি বিভিন্ন চালানের অর্থ আদায়, সরকারিভাবে আনা পণ্যের আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের সেবার মাসুল আদায় করা। কিন্তু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে এখন এসব কাজের বড় অংশই অনলাইনে হয়। আর সরকারি চালান আদায় ও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও যুক্ত হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতার কারণে তেমন কোনো আমদানির এলসিও খুলতে হচ্ছে না। এসব কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব ও কাজ এখন একেবারেই সীমিত। এ অবস্থায় ঋণ বিতরণও প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মীদের বড় অংশের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। এসব ব্যাংকের দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তা মনে করেন কিছু কর্মী কেবল ‘বসে বসে বেতন নিচ্ছেন’।

বিদ্যমান বাস্তবতায় সরকারের মালিকানায় এত ব্যাংক রাখার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চালান আদায়, ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা, বেতন-ভাতা ও পেনশন পরিশোধসহ সরকারের অনেক কাজ এখন অনলাইনে করা যায়। চালান আদায়ের কাজ এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোও করে। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর সরকারের নির্ভরতা অনেক কমে গেছে। আমি মনে করি, সোনালীসহ সরকারি খাতে দুই-তিনটি ব্যাংকই যথেষ্ট। এর মধ্যে কৃষি ব্যাংক কেবল কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে পারে।’

মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী আরো বলেন, ‘২০০৭ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল এসব ব্যাংককে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে ধীরে ধীরে সরকারের মালিকানা কমিয়ে আনা। কিন্তু রূপালী ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই পুঁজিবাজারে যেতে পারেনি। আর পুঁজিবাজারে যুক্ত হওয়ার পরও রূপালী ব্যাংকের সার্বিক অবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। দেশের ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে হলে সব ক্ষেত্রেই কার্যকর সংস্কার করতে হবে। এজন্য যে ধরনের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল, সেটি গত এক বছরে দেখিনি।’

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংস্কারে বেশকিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ নেন। অন্তত ১৪টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন তিনি। এগুলোর ব্যবস্থাপনায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংকে রূপান্তরের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তবে এ সময়ে বেসরকারি খাতে সংস্কার উদ্যোগের তুলনায় সরকারি ব্যাংক সংস্কারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করে। গত বছরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও এমডি পদে পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে এসব ব্যাংকের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি বা লুটপাট হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে বিশেষ কোনো নিরীক্ষা হয়নি।

সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। দেড় দশক ধরে এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। যেসব আমলা সেসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন তাদেরও চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ গত এক বছরে দেখা যায়নি। আবার অনেক আমলা নিজেরাই এসব ব্যাংকের পর্ষদে ছিলেন। সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাংকগুলোর পর্ষদে থাকা আমলাদের দায় ও সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখার কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬১ কোটি টাকায় ঠেকেছে। বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশই এখন খেলাপি। আবার খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণেও ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। সোনালী ব্যাংক ছাড়া বাকি তিন ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৮ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এ ছয় মাসে জনতা ব্যাংক আবার ২ হাজার ৭২ কোটি টাকার নিট লোকসানও গুনেছে। এর বাইরে বেসিক ব্যাংকের লোকসান ও ক্ষত আরো বেশি গভীর হয়েছে। ব্যাংকটির ঋণের ৮ হাজার ৯৩০ কোটি টাকাই খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৬৯ দশমিক ২০ শতাংশ। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) বিতরণকৃত ঋণের ৪২ দশমিক ১০ শতাংশ খেলাপির খাতায় চলে গেছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মতোই নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে বিশেষায়িত তিন ব্যাংক। এর মধ্যে বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। কেবল গত ছয় অর্থবছরে এ ব্যাংককে গুনতে হয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিট লোকসান। মূলধন ঘাটতি গিয়ে ঠেকেছে ২৯ হাজার ২০৭ কোটি টাকায়। ব্যাংকটির ঋণখেলাপির চিত্রও উদ্বেগজনক। চলতি বছরের জুন শেষে মোট ঋণের ৪৯ দশমিক ৪৪ শতাংশই খেলাপি, যার পরিমাণ ১৭ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা বলে ব্যাংকের নথিপত্রে উঠে এসেছে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরিস্থিতিও প্রায় একই। বিশেষায়িত এ ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ২২ শতাংশের বেশি এখন খেলাপি। আর ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬২০ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের নিয়মিত কাজ যে কমে গেছে তা এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ স্থিতির চিত্রেও ফুটে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক তথা সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ১২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। পরবর্তী ছয় মাসে তা না বেড়ে উল্টো ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা কমেছে। চলতি বছরের জুন শেষে চার ব্যাংকের ঋণ স্থিতি নেমে এসেছে ৩ লাখ ৪ হাজার ২২৬ কোটি টাকায়। এ চার ব্যাংকের পাশাপাশি বেসিক, বিডিবিএল, বিকেবি, রাকাব ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকেরও ঋণ স্থিতি না বেড়ে উল্টো সংকুচিত হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিজেকে সরকারি কর্মচারী পরিচয় দেয়া ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কর্মীদের এখন তেমন কোনো কাজ নেই। অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে এমনিতেই ব্যাংক ঋণের চাহিদা নেই। কিন্তু চাহিদা তৈরি হলেও বেশির ভাগ ব্যাংকে ঋণ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত তারল্য নেই। শাখা পর্যায়ে ‘ক্যাশ কাউন্টারে’ দায়িত্ব পালনকারী কর্মীদের কিছু কাজ আছে। বাকিরা ব্যাংকে এসে খোশগল্প করে সময় কাটাচ্ছেন।’

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির আমানত স্থিতি ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা (আন্তঃব্যাংক আমানত ছাড়া)। এত বিপুল পরিমাণ আমানত থাকা সত্ত্বেও জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ৮৯ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা (স্টাফ ঋণ বাদ দিয়ে)। যদিও গত বছরের ডিসেম্বরে এ ব্যাংকের ঋণ স্থিতি ৯৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ছিল। সে হিসাবে সোনালী ব্যাংকের ঋণ স্থিতি না বেড়ে উল্টো ৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা কমেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ এ ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) এখন মাত্র ৫৭ শতাংশ।

চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) সোনালী ব্যাংক ৩ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা পেয়েছে। তবে এ মুনাফার বেশির ভাগ এসেছে সরকারি কোষাগার থেকে। উচ্চ সুদের ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকটি ছয় মাসে ৪ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা আয় করেছে। যেখানে সুদ খাত থেকে ব্যাংকটির আয় হয়েছে মাত্র ৫৭৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কিছুটা কম। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ১৩ শতাংশ।

অবশ্য সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শওকত আলী খান বণিক বার্তাকে বলেছেন, ‘কেবল ঋণ স্থিতির দিকে তাকালে মনে হবে আমরা কোনো ঋণ দিচ্ছি না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা বড় ঋণ না দিলেও এসএমই খাতে অনেক ঋণ বিতরণ করেছি। ব্যাংকের অন্যান্য আর্থিক সূচকও উন্নতি হচ্ছে।’

গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে জনতা ব্যাংক। বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা, এননটেক্স, ক্রিসেন্টসহ বেশকিছু বড় গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণ এখন খেলাপির খাতায় উঠেছে। এ কারণে জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১০৭ কোটি টাকায়। জনতা ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৭৫ দশমিক ৯১ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি। ব্যাংকটির সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ৪৫ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকায় ঠেকেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ২ হাজার ৭২ কোটি টাকা। অর্থের সংকটে থাকা জনতা ব্যাংক এখন ১১-১৩ শতাংশ সুদেও মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। উচ্চ সুদের এ আমানত দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকটিকে আরো কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

খারাপ পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মজিবর রহমানও। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেয়ার সময় আমি একটি বিধ্বস্ত ব্যাংক পেয়েছি। সে অবস্থা থেকে ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। নেতিবাচক ভাবমূর্তি সত্ত্বেও ১৬ হাজার কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। বিপুল পরিমাণ এলসি দায় বকেয়া ছিল। সেসব দায় এরই মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা একই শাখা কিংবা বিভাগে তিন বছরের বেশি থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু জনতা ব্যাংকে অনেক কর্মকর্তা একই জায়গায় সাত-আট বছর ধরে বসে ছিলেন। এ ধরনের কর্মকর্তাদের বদলি করেছি। তবে আর্থিক পরিস্থিতির কারণে ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’

জনতার মতোই আর্থিকভাবে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি ৭২ হাজার কোটি টাকায় আটকে আছে। এর মধ্যে ৩২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকাই উঠেছে খেলাপির খাতায়, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪১ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ঠেকেছে ১১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকায়।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির এমডির দায়িত্বে ছিলেন। ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের বিরাজমান সংকট কল্পনারও বাইরে। ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকটিকে একেবারে শেষ করে ফেলা হয়েছে। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দেখলাম ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট থেকে (বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের উদ্দেশ্যে খোলা হিসাব) প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ডেবিট হয়েছে, কিন্তু গ্রাহকের হিসাব থেকে তা ডেবিট হয়নি। ৭৩৫ দিন ধরে এ পরিমাণ অর্থ ওভারডিউ রাখা হয়েছে। আমার দীর্ঘ ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে এত বড় জালিয়াতির কথা শুনিনি।’

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘গত দেড় দশকে অগ্রণী ব্যাংক থেকে কেবল আওয়ামী ঘরানার লোকেরা ঋণ পেয়েছে। জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অনেক ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এখন সেসব ঋণ আর ফেরত আসছে না। বর্তমানে এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৪০ শতাংশ। অথচ ২০১০ সালে শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আমি যখন দায়িত্ব শেষ করি তখন অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা বা ১০ শতাংশেরও কম। এত ভালো একটি ব্যাংককে পরবর্তী সময়ে শেষ করে দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর নগদ আদায়, পুনঃতফসিলসহ আইন অনুমোদিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’

আর্থিক সব সূচকে নিম্নমুখী অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকও। চলতি বছরের ছয় মাসে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি না বেড়ে উল্টো ১ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২ হাজার ১৭৯ কোটি টাকাই খেলাপির খাতায় উঠেছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র রাষ্ট্রীয় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার এখন ৪৪ শতাংশে ঠেকেছে। ব্যাংকটির সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭৬১ কোটি টাকায়।

রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলছেন, ‘ভালো গ্রাহক দেখে ঋণ দেয়া হচ্ছে। এ কারণে ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবও রয়েছে।’

প্রবাসীদের ঋণ দেয়ার কথা বলে ২০১০ সালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। যদিও প্রতিষ্ঠার দেড় দশক পেরিয়েও ব্যাংকটি বিকশিত হতে পারেনি। ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরুর আগেই কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। অদক্ষ জনবল নিয়োগের সে ধকল এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। গত অর্থবছর পর্যন্ত ব্যাংকটির আমানত স্থিতি ছিল মাত্র ১৭২ কোটি টাকা। যদিও একই সময়ে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকটি।

দেশের কৃষকদের ঋণ দিতে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কৃষি ব্যাংক ভেঙে রাজশাহী অঞ্চলের শাখাগুলোকে নিয়ে ‘রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)’ প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষি ব্যাংকের মতো রাকাবের আর্থিক অবস্থাও এখন বেশ নাজুক। কয়েক বছর ধরে বিশেষায়িত এ দুটি ব্যাংক একীভূত করার আলোচনা চলছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এখনো সে প্রক্রিয়া শুরুই করা যায়নি।

এ দুই ব্যাংকের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ ছিল বিকেবির সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করে কৃষকদের জন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এ সহজ কাজ করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ব্যাংকের সংখ্যা কমুক, এটি আমলারা চান না। কারণ ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হলে এমডি বা শীর্ষ নির্বাহী বেশি দরকার হবে। আবার ডিএমডি, জিএমের সংখ্যাও বাড়বে। এসব পদে পদোন্নতি কিংবা নিয়োগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আমলারা নিয়ন্ত্রণ করেন। একীভূত করলে পদ কমে যাওয়া তথা এক্ষেত্রে নানাবিধ অনিয়মের সুযোগ কমে যাওয়ার ভয় থেকে অনেক আমলা ব্যাংক দুটি একীভূতকরণের বিপক্ষে ভূমিকা রাখেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কারে যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এনবিআরের সংস্কারকাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সংস্কারে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে এরই মধ্যে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কারের কাজ এগিয়ে নেয়া হয়েছে। শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে একটি ব্যাংকে রূপান্তরের উদ্যোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলো সংস্কারে নজর দেয়া হবে।’

(বণিক বার্তা, ১৯.১১.২০২৫)

ব্যাংকার প্রতিবেদন

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন