ব্যাংকার প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯:৪০, ২২ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১৯:৪১, ২২ আগস্ট ২০২৫
ধুঁকতে থাকা ৯টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতি—এই তিন সূচককে ভিত্তি ধরে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘অপরিচালনযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে— এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। বৈঠকে ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ (অবসায়ন) করার প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়ে গভর্নর অনুমোদন দেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষে এনবিএফআই খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে ৫২ শতাংশ খেলাপি ঋণ এ ৯টি প্রতিষ্ঠানের।
ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩ অনুযায়ী লাইসেন্স বাতিল করে অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য ব্যাংকের রেজুলেশন বিভাগে পাঠানো হয়েছে। অবসায়নের সময় ক্ষুদ্র আমানতকারীরা যেন তাদের জমা টাকা ফেরত পান, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি যেসব কর্মী এখন এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তারা চাকরিবিধি অনুযায়ী সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলেও জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেজুলেশন ডিপার্টমেন্ট এরই মধ্যে গভর্নরের সম্মতি নিয়ে অবসায়নের প্রস্তুতি নিতে কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৯টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপুল অংশ খেলাপি। এর মধ্যে এফএএস ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ৯৯ দশমিক ৯৩ শতাংশই খেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির ক্রমপুঞ্জিভূত লোকসান ১ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৯৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) খেলাপি ঋণ ৯৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, লোকসান ১ হাজার ৪৮০ কোটি। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা, যার ৯৬ শতাংশই আদায় অযোগ্য। প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত লোকসান ৪ হাজার ২১৯ কোটি টাকা।
এছাড়া পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৯৫ শতাংশ, লোকসান চার হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৩ শতাংশ, লোকসান তিন হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৭৫ শতাংশ, লোকসান ৯৪১ কোটি টাকা। জিএসপি ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৫৯ শতাংশ, লোকসান ৩৩৯ কোটি টাকা। প্রাইম ফাইন্যান্সের ৭৮ শতাংশ ঋণ খেলাপি, লোকসান ৩৫১ কোটি টাকা।
দেশের আর্থিক খাতে বর্তমানে মোট ৩৫টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের হার ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিপরীতে এসব ঋণের বন্ধকি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের মাত্র ২৬ শতাংশ।
দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গত জানুয়ারিতে এই ২০টি এনবিএফআইকে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স কেন বন্ধ করতে হবে না তা জানতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ৯টি প্রতিষ্ঠানের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় সেগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর আর্থিক অবস্থা উন্নতি করার সুযোগ পেয়েছে বাকি ১১ প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বাকি ১১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তাদের মূলধন বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে। এ সময় যদি তারা মূলধন বাড়িয়ে আর্থিক অবস্থা উন্নতি করতে পারে, তাহলে তারা থাকবে। আর না পারলে তাদেরকেও ৯টি ব্যাংকের মতো বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার কিনে নিলেও খেলাপি ঋণের টাকা আদায় কার্যক্রম চলবে। লিকুইডেশন যাওয়া মানেই প্রত্যেকটি অ্যাসেট নিয়ে, এখানে বন্ধকি সম্পত্তি আছে- সেটা উদ্ধার করার চেষ্টা করা হবে তা যত বছরই লাগুক না কেন।”
এএ
ব্যাংকার প্রতিবেদন