ঢাকা, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৭

রন্ধনশিল্প: বাংলাদেশি তরুণদের বিদেশে চাকরির নতুন দুয়ার

ব্যাংকার প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১১:০৫, ১৫ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১১:০৫, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

রন্ধনশিল্প: বাংলাদেশি তরুণদের বিদেশে চাকরির নতুন দুয়ার

দেশের প্রাচীনতম সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের (এনএইচটিটিআই) রান্নাঘরের কর্মব্যস্ততা যেন কোনো পেশাদার রেস্তোরাঁর মতোই। শিক্ষার্থীরা শেফ কোট পরে মেন্যু তৈরির খরচ নির্ধারণ করা শিখছেন। আধুনিক হোটেলে রান্নাঘরের আদলে তৈরি ল্যাবে অনুশীলন করছেন।

প্রতিবছর আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বিভিন্ন রন্ধনশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে স্নাতক সম্পন্ন করছেন। তাঁদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতার ও ইউরোপের মতো দেশগুলোতে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন।

শেফ প্রশিক্ষণের এই ক্রমবর্ধমান সংস্কৃতি এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে দক্ষ রন্ধনকর্মী সরবরাহকারী একটি দেশ হিসেবে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে।

২০২৩ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় 'শেফ' ও 'বেকার' পদ দুটিকে দক্ষ অভিবাসনের নতুন বিভাগ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা এখন স্বীকৃত সনদ দেখিয়ে বিদেশে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারছেন।

খাত-বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ধারা নার্সিং ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মতোই একটি নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটা সময় এসব পেশার চাহিদা সীমিত থাকলেও এখন তা দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের তথ্যমতে, সরকারি পর্যায়ের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (এনএইচটিটিআই) থেকে প্রতি বছর গড়ে দুই হাজার শিক্ষার্থী বেকারি, ফুড প্রোডাকশন, ফ্রন্ট অফিস ও হাউসকিপিংয়ের মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬০০ জন রন্ধনশিল্পের সঙ্গে যুক্ত।

এনএইচটিটিআইয়ের বেকারি ও পেস্ট্রি প্রোডাকশন ট্রেনার মইনুল ইসলাম বলেন, 'আমরা একটা স্পষ্ট পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আগে শিক্ষার্থীরা মূলত দেশের বাজারে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে আসত। এখন প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীই বিদেশে দক্ষ শেফ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়। রন্ধনশিল্প এখন অনেকের কাছেই অভিবাসনের একটি অন্যতম পথ হয়ে উঠেছে।'

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি) স্বীকৃত 'ফুড প্রোডাকশন অ্যান্ড প্যাটিসেরি' বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা করতে এখানে খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকা। কোর্স শেষে শিক্ষার্থীরা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মাধ্যমে অথবা আন্তর্জাতিক হোটেল চেইনগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বিদেশে চাকরির আবেদন করতে পারেন।

মইনুল ইসলামের মতে, শুধু রান্নার দক্ষতা নয়, সফট স্কিল বা সাধারণ দক্ষতাও সমান জরুরি। তিনি বলেন, 'বিদেশে কাজ করার অর্থ নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং কাজের চাপ সামলানো। আমরা শিক্ষার্থীদের সময়নিষ্ঠা, দলবদ্ধভাবে কাজ করা এবং স্বাস্থ্যবিধির মতো বিষয়গুলো শেখাই, যেগুলোর সঙ্গে কোনো আপস চলে না।'

বস্তুত, দেশের ভেতরেও রন্ধনশিল্প খাত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। নতুন নতুন রেস্তোরাঁ, বুটিক ক্যাফে ও ক্যাটারিং স্টার্টআপ গড়ে ওঠায় প্রশিক্ষিত রাঁধুনির চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের আতিথেয়তা খাতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ কর্মরত, যাঁদের একটি বড় অংশই প্রশিক্ষিত শেফ।

নানা সম্ভাবনার পরও রন্ধনশিল্পের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যথাযথ স্বীকৃতি বা আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব নেই, ফলে তাদের সনদ বিদেশে সব সময় গ্রহণযোগ্য হয় না।

প্রশিক্ষকেরা মনে করেন, এ খাতে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয় আরও বাড়ানো জরুরি। 

অন্যদিকে, প্রশিক্ষণের খরচও একটি বড় বাধা। দীর্ঘমেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সের ফি সাধারণত ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা, যা অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের নাগালের বাইরে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, বৃত্তি এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে এই সংকট কাটানো সম্ভব।

রন্ধনশিল্প এখন আর শুধু পেশা নয়—এটি বাংলাদেশের তরুণদের জন্য বৈশ্বিক দরজায় প্রবেশের নতুন চাবিকাঠি। খাবারের চাহিদা কখনো ফুরায় না, আর রান্নার শিল্প শেখা মানে জীবনের জন্য একটি দক্ষতা অর্জন করা। বাংলাদেশের তরুণদের হাতে সেই শক্তিটাই এখন গড়ে উঠছে—রান্নাঘর থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত।

এএ

ব্যাংকার প্রতিবেদন

আরও পড়ুন